করোনায় থাবায় সর্বস্বান্ত নিম্ন মধ্যবিত্তরা

আমাদের দেশে মহামারী করোনা হানা দেওয়ার পর বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। করোনায় এ পর্যন্ত ১২ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৮ লাখ মানুষ। করোনা রোগীর চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বে মানুষ স্বজনদের বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। কেউ বেঁচে ফিরছে। চেষ্টা সত্ত্বেও অনেককেই বাঁচানো যাচ্ছে না। এই ব্যয় মেটাতে গিয়ে অনেক পরিবারকে পথে বসতে হচ্ছে। করোনার কারণে এমনিতেই অসংখ্য মানুষের আয় কমেছে। চাকরি হারিয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চিকিৎসা ব্যয়। সবকিছু মিলে দিশেহারা অবস্থা নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের।

ব্যবসায়ী ফরহাদ হোসেনের মাসে যা আয় হতো তা দিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ বেশ ভালোভাবেই হতো। করোনা আক্রান্ত মাকে বাঁচানোর চেষ্টায় দিনে লাখ টাকার বেশি গুনতেও কার্পণ্য করেননি। কিন্তু মা ফাতেমা রহমান আইসিউ থেকে আর বাড়ি ফিরলেন না। চিকিৎসার জন্য করা ধার-দেনা মেটাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে পুরো পরিবার।

ঢাকার একটি হাসপাতালে এক মাসের বেশি সময় চিকিৎসা নেওয়ার পর গত ২ মে রাতে মারা যান তিনি। পরিবারটিকে আইসিইউর ৩১ দিন ৮ ঘণ্টা ৪ মিনিটের বিল চুকাতে হয়েছে। এর আগে করোনায় মারা যান ফরহারে বড় বোনোর স্বামী। তার চিৎিসা ব্যয়ও মেটাতে হয়েছে ফরহাদকে। একান্ত আপন দুই স্বজনের চিকিৎসার পেছনে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে তার।

ঠাকুরগাঁওয়ে বীজ ও কৃষি পণ্যের ব্যবসায়ী ফরহাদ বলেন, আইসিইউতে একেক দিনের বিল আসত ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা। কোনো কোনো দিন লাখ টাকার শুধু ওষুধই কিনতে হয়েছে। সেই ধার শোধ দিতে এখন সম্পত্তি বিক্রির কথা ভাবতে হচ্ছে। ফরহাদ পারলেও প্রিয়জনের চিকিৎসার জন্য ধার-দেনা করেও এত টাকা জোগাড় করার সামর্থ্য আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের নেই।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের হিসাবে এ বছর ২৮ জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ৪৪ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। বাকিরা বাসায় চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে গেছেন।

তবে যাদের হাসপাতালে যেতে হয়েছে, তাদের চিকিৎসার জন্য বড় অংকের টাকাই বেরিয়ে গেছে। সাধারণ শয্যায় এই খরচ গড়ে সোয়া এক লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা। আর আইসিইউতে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। সরকারি হাসপাতালে খরচের বেশিরভাগটাই সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেয় বলে রোগীদের ততটা চাপে পড়তে হয় না। কিন্ত যাদের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে, তাদের অনেকেই আর্থিকভাবে বড় ধাক্কা খেয়েছেন।

ঢাকার আদাবরের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করেন। স্ত্রী, বাবা-মা আর ছোট ভাই মিলে একসঙ্গেই থাকতেন। এপ্রিলের শুরুতে একসঙ্গেই তারা করোনা আক্রান্ত হন।

মামুন জানান, কোভিড ধরা পড়ার তিন দিনের মাথায় রাতের বেলা তার বাবার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। অ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই মারা যান তিনি। আর নিজে ভর্তি হন হাসপাতালে। বাড়ির অন্যরা বাসায় কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। মামনি বলেন, বাবা চলে গেলেন, মাটিটাও দিতে পারলাম না। স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, বয়স্ক মা। হাসপাতলে আমার আট দিন থাকতে হয়েছে। আট দিনেই প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট এক গবেষণায় দেখেছে, কোভিড চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালে প্রতি রোগীর জন্য সাধারণ শয্যায় খরচ গড়ে এক লাখ ২৮ হাজার টাকা; আইসিইউতে চার লাখ আট হাজার টাকা। আর বেসরকারি হাসপাতালে প্রতি রোগীর জন্য খরচ সাধারণ শয্যায় গড়ে দুই লাখ ৪২ হাজার টাকা। আইসিইউতে পাঁচ লাখ নয় হাজার টাকা।

গত বছর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশের চারটি কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতাল এবং দুটি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য নিয়ে এই হিসাব করেছে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট।

এ গবেষণায় সাধারণ শয্যার ৩১ হাজার ১৪৭ জন এবং আইসিইউতে চিকিৎসা নেওয়া দুই হাজার ৯১৮ জন রোগীর খরচ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

গবেষণার পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (উপ-সচিব) ড. নুরুল আমিন বলেন, সরকারি হাসপাতালের যে খরচ দেখানো হয়েছে, তার প্রায় পুরোটাই আসলে সরকারের ব্যয়। বেডে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অতিরিক্ত খরচ হয় সাত হাজার টাকা এবং সরকারি আইসিইউতে থাকা রোগীদের অতিরিক্ত খরচ হয় ৩৩ হাজার টাকা। আর বেসরকারি হাসপাতালের খরচের পুরোটাই রোগীদের পকেট থেকেই যায়।

হিসাব করে দেখেছেন, ওই সময় সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে রোগী প্রতি গড়ে আট দিন থাকতে হয়েছে। আর বেসরকারি আইসিইউতে অবস্থানের গড় সময় ৭.৩৯ দিন।

সরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় রোগীর গড় অবস্থানের সময় ১০ দিন, আর বেসরকারি হাসপাতালে ৬.৫২ দিন। অবস্থানের গড় সময় ধরে হিসাব করলে বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় চিকিৎসার দৈনিক খরচ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ১১৬ টাকা। আইসিইউতে দৈনিক খরচ হয় গড়ে ৬৮ হাজার ৮৭৬ টাকা।

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গড় অবস্থানের তারতম্যের কারণ জানতে চাইলে ড. আমিন বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে খরচ বেশি। তাই রোগী মোটামুটি ভালো হলেই পরিবারের পক্ষ থেকে ছেড়ে দেওয়ার চাপ দেওয়া হয়।

কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার বড় খরচের আরেকটি কারণ ওষুধের দাম। অধিকাংশ হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসায় যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, তার একটি হল রেমডেসিভির। খোলা বাজারে ১০০ মিলিগ্রামের ভায়াল বিক্রি হয় কোম্পানি ভেদে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায়। পুরো কোর্স সম্পন্ন করতে রোগীর খরচ হয় ৩০ হাজার টাকার বেশি। সংকটাপন্ন রোগীদের অনেকের ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে টোসিলিজুমাব (অ্যাকটেমরা) ইনজেকশন। এর পুরো ডোজের দাম পড়ছে রোগীর ওজন ভেদে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা।

করোনা আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হন, তাদের সবারই কমবেশি নিউমোনিয়ার সমস্যা থাকে। ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঠেকাতে রোগীদের দেওয়া হয় অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন। প্রতি ডোজের দাম হাজার টাকার কাছাকাছি।

এ ছাড়া অক্সিজেন এবং অন্যান্য ওষুধের খরচও আছে। রোগীদের প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু প্যাথলজি টেস্ট করাতে হয়। অনেক সরকারি হাসপাতালে সব টেস্ট হয় না। বেসরকারি হাসপাতালে এসব টেস্টের জন্য দিনে গড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। এসব কারণেও খরচ অনেক বেড়ে যায়।