কে হবেন প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় ঐক্যে নতুন জটিলতা!
সরকারবিরোধী বৃহত্তর প্ল্যাটফর্ম গঠন প্রক্রিয়া কয়েকটি বিষয়ের জটিলতায় আটকে আছে। জোটগত নাকি যুগপৎ আন্দোলন, কে হবেন জোটপ্রধান, ক্ষমতায় গেলে সরকারপ্রধান কে হবেন এমন নানা প্রশ্নে এখনো বিভক্ত ঐক্যপ্রক্রিয়ার উদ্যোক্তারা। এ অবস্থায় ২২ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় ঐক্য’ দৃশ্যমান হওয়ার কথা থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে। ড. কামাল হোসেন ছাড়া কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের ‘উচ্চাভিলাসী’ মনোভাবে ঐক্যপ্রক্রিয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখছে বিএনপি।
নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘আমার প্রস্তাব বিএনপির সঙ্গে ঐক্যের পর ক্ষমতায় আসতে পারলে দুই বছর ক্ষমতা আমাদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।’ এ বক্তব্যে বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ার প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং তাদের নেতৃত্বাধীন জোট নেতারা মনোক্ষুণ হয়েছেন।
জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কে হবেন এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। জাতীয় ঐক্যের প্রধান কে হবেন তা নিয়েও বিএনপি, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ আছে।
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার আগে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে বিএনপির নির্বাহী কমিটির বৈঠকে দেশের সরকারের বাইরে থাকা সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির আহ্বান জানান। এর আগে ২০১৬ সালে গুলশানে জঙ্গি হামলার পর সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা-ও শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। সেবার জাতীয় ঐক্য না হওয়ার পেছনে বিএনপির জামায়াতসঙ্গ মূল বাধা হিসেবে দাঁড়ায়। এবারও জামায়াত ইস্যুর সঙ্গে নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি।
এদিকে জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে ২০-দলীয় জোটের অন্য শরিকরা অন্ধকারে থাকায় তাদের মধ্যেও ক্ষোভ বাড়ছে। জোটের একাধিক নেতা বলেন, এর আগে ভারতকে কাছে টানতে গিয়ে ভারতবিরোধী বিদেশি অনেক শক্তি বিএনপিকে আগের মতো বন্ধু ভাবে না। এবার জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে ২০-দলীয় জোটকে সেভাবে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। এমনকি এখন যেসব কর্মসূচি হচ্ছে সেখানে ২০-দলীয় জোটের নেতাদের ডাকা হচ্ছে না। এই অবস্থায় মনে হচ্ছে বিএনপি একলা চলো নীতিতে রয়েছে।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমার প্রস্তাব বিএনপির সঙ্গে ঐক্যের পর ক্ষমতায় এলে দুই বছর ক্ষমতা আমাদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এতে অসুবিধা কোথায়? মালয়েশিয়াতে মাহাথির মোহাম্মদ যদি ১১ সদস্য নিয়ে ২ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, আমরা যদি চল্লিশ আসনে জয়লাভ করি, তাহলে দিতে সমস্যা কোথায়?
বিএনপি এ প্রস্তাবে রাজি না হলে কী হবে, জানতে চাইলে যুক্তফ্রন্টের এই নেতা বলেন, ‘যদি না মানে, না-ই মানল, তা হলে হবে না।’
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আইনের শাসন, স্বাধীনতাসহ মেলা কাজ করতে হবে। এই কাজ দুই বছরে হবে না। এজন্য সময় লাগবে; কিন্তু আমরা মনে করছি, যেহেতু বিএনপি বেশি সংখ্যক আসনে জয়লাভ করবে; কিন্তু তাদের ক্ষমতা দেবই না, এটা বলছি না। আমরা বলছি, দেশে এখন সংঘাতময় রাজনীতি। এই সংঘাত থেকে বের হওয়ার সুযোগ আমাদের মাধ্যমে হতে পারে।
মান্নার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সভাপতি কর্নেল (অব) অলি আহমেদ বীরবীক্রম বলেন, বিএনপি কাদের সঙ্গে ঐক্য করছে এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। আমার সঙ্গে তাদের কোনো আলাপও হয়নি। বিএনপি অনেকদিন ধরে এই নিয়ে এককভাবে কাজ করে আসছে। ড. কামাল হোসেন অথবা বদরুদ্দোজা চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে যখন কোনো বৈঠক হয়েছে, সেখানে ২০-দলীয় জোটের শরিক কোনো নেতা ছিল না।
সুতরাং মান্না কোন প্রেক্ষাপটে তাদের ২ বছর রাষ্ট্র চালাতে দিতে হবে বলেছেন, সেটি তিনি ভালো বলতে পারবেন। তবে সেই রামও নেই, অযোধ্যাও নেই। তিনি বলেন, মাহাথির ২৩ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তার বিরুদ্ধে কোনো দলীয়করণ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ছিল না। তিনি আধুনিক মালয়েশিয়ার নির্মাতা। আমি মনে করি না, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের ওই ধরনের যোগ্যতা আছে। আজ রাজনীতিবিদরা জনগণের আসামি। দেশপ্রেমের কথা বলি, ক্ষমতার লোভ তাতে প্রাধান্য পায়; ক্ষমতায় যাইতে চাই। আমরা শুধু আসন দখল করতে চাই। এই মনোভাব পরিহার করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে আমাদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে হবে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। লোভ-লালসা থাকা ভালো, অতি লোভ মানুষকে ধ্বংস করে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি এখন যৌথ নেতৃত্বে চলছে। এ বিষয়ে আমার একার পক্ষে মতামত দেওয়া সম্ভব নয়। এ ধরনের কোনো প্রস্তাব আমাদের কাছে আসেনি। প্রস্তাব এলে দলের স্থায়ী কমিটি আছে, সেখানে আলোচনা হতে হবে, তারপর চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মতামতের সুযোগ নিতে হবে; তারেক রহমানের মতামত নিতে হবে।
এই অবস্থায় জাতীয় ঐক্য নিয়ে তারা আশাবাদী কিনা জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির এই সিনিয়র নেতা বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ১০ বছর ধরে আমরা যে কথাগুলো বলে আসছি, ক্ষমতাসীনরা ছাড়া অন্যসব রাজনৈতিক দল এখন একমত পোষণ করছে। সেজন্য নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ইস্যুতে একটা জাতীয় ঐক্য হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৮ দল, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল এবং হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ৫-দলীয় জোটের মতো এবার যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে তারা আগ্রহী। তবে যুক্তফ্রন্ট জোট গঠন করতে চায়। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার আন্দোলনের বিষয়টি জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার মধ্যে আসবে না।
জানা গেছে, যুগপৎ আন্দোলনের ক্ষেত্রে জামায়াতকে নিয়ে সমস্যা হবে না বলে মনে করা হচ্ছে; কিন্তু জোট গঠনের ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধের দল জামায়াতের ব্যাপারে আপত্তি আছে যুক্তফ্রন্টের প্রায় সবার।
জানা গেছে, বৃহত্তর এই প্ল্যাটফর্ম কিংবা জাতীয় ঐক্যের নেতৃত্বে কে থাকবেন, এই প্রশ্নে প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত রূপ দিতে বিলম্ব হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটি কয়েক দফা বৈঠকে জাতীয় ঐক্যের ১৫ দফা খসড়া তৈরি করেছে।
খসড়ার মধ্যে রয়েছে- ১. চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার, তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে ফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব মামলা স্থগিত রাখা, নতুন মামলা না দেওয়ার নিশ্চয়তা আদায় করা, পুরনো মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার না করার নিশ্চয়তা আদায়, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলন, সামাজিক গণমাধ্যমে মন্তব্যের অভিযোগে গ্রেপ্তার ও ছাত্র-ছাত্রীসহ সবার মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তির নিশ্চয়তা; ২. নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া; ৩. সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা; ৪. আলোচনা করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন; ৫. নির্বাচনের স্বচ্ছতার জন্য দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; ৬. ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে ভোটকেন্দ্রে সশস্ত্রবাহিনী নিয়োগ; ৭. ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না; ৮. রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অবসান করতে জাতীয় ঐকমত্য গঠন; ৯. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা; ১০. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা; ১১. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; ১২. দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠানসমূহের সংস্কার; ১৩. নাগরিকের মৌলিক ও মানবাধিকার নিশ্চিত; ১৪. আয়ের বৈষম্য অবসানে আর্থিকনীতি গ্রহণ এবং ১৫. রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত করা।
প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক নেতা বলেন, ঐক্যের মধ্য দিয়ে এ সরকারের পতন ঘটিয়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চান; কিন্তু সন্দেহ রয়েছে বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে নিয়ে।
কারণ, তার ছেলে মাহী বি চৌধুরীর সঙ্গে সরকারের কোনো এক নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এই অবস্থায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে বদরুদ্দোজা চৌধুরী তার সিদ্ধান্তে কতটুকু স্থির থাকতে পারবেন, এ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
ওই নেতারা বলেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং ড. কামাল হোসেনের মধ্যে ঐক্য হলেও জাতীয় ঐক্যের প্রধান কে হবেন, তা নিয়ে জটিলতা আছে। বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। ড. কামালকে প্রধান করলে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অনুসারীরা বেঁকে বসতে পারেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন