কোরবানির পশুর হাট ঘিরে সক্রিয় সিন্ডিকেট

এবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বসছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৫টি পশুর হাট। এসব পশুর হাট ইজারা দিতে সব ধরনের কার্যক্রম শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এসব হাট কম মূল্যে ইজারা নিতে গড়ে উঠছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা হাট ইজারা নিতে নানাভাবে চক্রান্ত করছে। একপর্যায়ে বাধ্য হয়েই প্রতি বছর এদের হাট ইজারা দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ফলে শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাতে পারে দুই ডিসিসি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রটি জানায়, কোরবানির হাট ইজারা নিতে বছরজুড়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা দুই ডিসিসিতে নানা তদবির বাণিজ্যে লিপ্ত থাকেন। যখন পশুর হাটের ইজারার সময় চলে আসে তখন আগের চেয়ে নেতাকর্মীদের প্রভাব কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তবে আগের বছরগুলোয় একই পদ্ধতি অনুসরণ করে হাট ইজারা হলেও এবার অনিয়মের মাত্রা বেড়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

দুই ডিসিসির মতে, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় এবং সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু লোকজনের সহযোগিতায় প্রভাবশালীরা একেকটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। কোনো বছরই এই সিন্ডিকেটের বাইরে পশুর হাট ইজারা দেওয়া হয় না। পরে বাধ্য হয়ে কাঙ্ক্ষিত দর বা ইজারাদার না পেয়ে খাস আদায়ের জন্য হাট ছেড়ে দেওয়া হয়। এই খাস আদায়ের টাকা বেশিরভাগই চলে যায় সিন্ডিকেটের পকেটে। আর সিটি করপোরেশন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।

এদিকে ঈদুল আজহার মাসাধিক বাকি। এর মাঝেই কোরবানির পশুর ১৪টি হাটের জন্য দরপত্র আহ্বান করে ইতোমধ্যে ১১টিতে ইজারাদার পেয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। বাকি তিনটিতেও ইজারাদার পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী সংস্থাটি। যদিও অনেকেই বলছেন, এসব হাটের ইজারা নিয়ে দোটানায় পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ইজারাদাররা দরপত্র জমা দিলেও কোনো দর উল্লেখ করছেন না। দ্বিতীয় দফা দরপত্র খুলে এমন চিত্র দেখা গেছে।

ডিএসসিসি এবার মোট ১৪টি স্থানে অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। গত ১০ জুন এসব হাটের জন্য ইজারাদার ঠিক করতে প্রথম দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। ২৬ জুন দরপত্র খোলার পর দেখা যায় ১১টি হাটে সরকারি দরের চেয়ে বেশি দর পড়েছে। এ কারণে হাট মূল্যায়ন কমিটি সর্বোচ্চ দরদাতাদের হাটগুলো ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তিনটি হাটে সরকারি মূল্যের চেয়ে কম দর ওঠায় আবারো দরপত্র আহ্বান করা হয়। গত ৪ জুলাই বৃহস্পতিবার ছিল দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। পরে ডিএসসিসির কর্মকর্তারা দরপত্র বাক্স খুললে হতাশ হয় হাট ইজারা মূল্যায়ন কমিটি।

দেখা যায়, আফতাবনগরের হাটের জন্য মাত্র একজন দরপত্র জমা দিয়েছেন। জসিম উদ্দিন সবুজ নামে ওই দরদাতা অবশ্য এ হাটের সরকারি দর ৬৫ লাখ ৩০ হাজার থেকে কিছু বেশি ৬৭ লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন। তবে এ হাটে প্রথম দফায় দরপত্র জমা দেওয়া মোকাসেদ হোসেন কিসলু এবার কোনো দরপত্রই জমা দেননি। প্রথম দফা দরপত্রে তিনি মাত্র ২০ লাখ টাকা দর দিয়েছিলেন।

একইভাবে আমুলিয়া মডেল টাউনের আশপাশের খালি জায়গা নিয়ে গঠিত হাটে প্রথম দফায় দুটি দরপত্র জমা পড়েছিল। এবারো দুটি দরপত্র জমা পড়েছে। এ হাটের সরকারি মূল্য সাড়ে ১৮ লাখ টাকা। প্রথম দফায় এ হাটে আহসান উল্লাহ মাত্র ৪ লাখ টাকা দর দেন। এবার তিনি মাত্র ৫ লাখ টাকা দর দিয়েছেন। হেলাল উদ্দিন বেপারি নামে আরেকজন দরদাতা প্রথম দফা দরপত্রে ৩ লাখ টাকা দর দেন। দ্বিতীয় দফায় তিনি দরপত্র জমা দিয়ে পে-অর্ডার জমা দিলেও হাটের জন্য কোনো দর উল্লেখ করেননি।

শ্যামপুর বালুর মাঠসহ আশপাশের এলাকার খালি জায়গার হাটের বিপরীতে দুটি দরপত্র জমা পড়লেও কোনো দর উল্লেখ করা হয়নি। অথচ পে-অর্ডার জমা দেওয়া হয়েছে। এ হাটের সরকারি মূল্য ছিল ৯৮ লাখ ৫৮ হাজার ২৪৮ টাকা। এর বিপরীতে প্রথম দফা দরপত্রে মোট ৪ জন দরপত্র জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সিদ্দিকুর রহমান মাত্র ৪৫ লাখ টাকা, তাজুল ইসলাম ৩৫ লাখ টাকা, কাজী মো. শহীদ উল্লাহ ৩০ লাখ ও রাসেল ইকবাল ২৫ লাখ টাকা দর দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় দফায় এ হাটে হাজী আমিনুল ইসলাম এবং এস এম আমিনুর রহমান দরপত্র জমা দেন। প্রথম দফায় যারা দরপত্রে অংশ নিয়েছিলেন তারা কেউই দ্বিতীয় দফায় দরপত্রে অংশ নেননি, যা হাট নিয়ে ব্যবসায়ীদের লুকোচুরি খেলা বলে মনে করছে সিটি করপোরেশন।

ডিএসসিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শ্যামপুর ও আমুলিয়া হাটের বিপরীতে কাঙ্ক্ষিত দর না পাওয়ায় এ দুটি হাটের জন্য আবারো দরপত্র আহ্বান করতে হতে পারে। তবে হাট মূল্যায়ন কমিটির সভার পরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে।

এদিকে আমুলিয়া মডেল টাউন-সংলগ্ন হাটের ইজারায় অংশ নেওয়া আহসান উল্লাহ জানান, গত বছর এ হাটটি ইজারা নিয়ে তাদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এজন্য এ বছর দরপত্রে কম দর দেওয়া হয়েছে।

ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা চেষ্টা করি প্রভাবশালীদের বাদ দিয়ে সাধারণ ইজারাদারদের হাট দিতে। তারপরও প্রতি বছর সিন্ডিকেটের মাধ্যেমে হাট অনেকে ইজারা নিচ্ছে। এতে আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না। তবে যে সবচেয়ে বেশি দরদাতা তাকেই আমরা হাট ইজারা দেবো। তবে প্রত্যাশার চেয়ে দাম কম আসলে সেটি পুনরায় টেন্ডার ঘোষণা করে ইজারা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

ডিএনসিসি প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, হাট ইজারার ক্ষেত্রে কে কোন দল করেন সেটি এখানে দেখার সুযোগ নেই। যে সর্বোচ্চ দরদাতা তাকেই আমরা হাট ইজারা দিচ্ছি।

ডিএসসিসির ১৪টি স্থানে অস্থায়ী পশুর হাট : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার অস্থায়ী পশুর হাটের স্থানগুলো হচ্ছে লালবাগ রহমতগঞ্জ খেলার মাঠসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, কামরাঙ্গীরচর ইসলাম চেয়ারম্যানের বাড়ির মোড় থেকে দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর বাঁধসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, পোস্তগোলা শ্মশানঘাটসংলগ্ন খালি জায়গা, শনির আখড়া ও দনিয়া মাঠসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, ধূপখোলা মাঠসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউয়ারটেক মাঠসংলগ্ন আশপাশ এলাকার খালি জায়গা, আমুলিয়া মডেল টাউনের আশপাশের খালি জায়গা এবং দাওকান্দি ইন্দুলিয়া ভাগাপুরনগর (আফতাবনগর ইস্টার্ন হাউজিং মেরাদিয়া মৌজার সেকশন-১ ও ২) লোহারপুলের পূর্ব অংশ এবং খোলা মাঠসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, শ্যামপুর বালুর মাঠসহ আশপাশের খালি জায়গা, লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাবসংলগ্ন গোপীবাগ বালুর মাঠ ও কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন বিশ্বরোডের আশপাশের খালি জায়গা, মেরাদিয়া বাজারসংলগ্ন খালি জায়গা, উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজার মৈত্রী সংঘের মাঠসংলগ্ন ও আশপাশের খালি জায়গা, ঝিগাতলা-হাজারীবাগ মাঠসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সামসাবাদ মাঠসংলগ্ন আশপাশ এলাকার খালি জায়গা।

ডিএনসিসির অস্থায়ী পশুর হাটের স্থান : উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর ব্রিজের পশ্চিম অংশ এবং ২ নম্বর ব্রিজের পশ্চিমে গোলচত্বর পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশের ফাঁকা জায়গা। মোহাম্মদপুর বুদ্ধিজীবী সড়ক সংলগ্ন (বসিলা) পুলিশ লাইনের খালি জায়গা। মিরপুর সেকশন-৬, ওয়ার্ড-০৬ (ইস্টার্ন হাউজিং)-এর খালি জায়গা। খিলক্ষেত বনরূপা আবাসিক প্রকল্পের খালি জায়গা। খিলক্ষেত ৩০০ ফুট সড়ক সংলগ্ন উভয় পাশের বসুন্ধরা হাউজিংয়ের খালি জায়গা। ভাটারা (সাইদনগর) পশুর হাট। মিরপুর ডিওএইচএসের উত্তর পাশের সেতু প্রোপার্টি ও সংলগ্ন খালি জায়গার অস্থায়ী পশুর হাট। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট খেলার মাঠ। উত্তরখান মৈনারটেক শহিদনগর হাউজিংয়ের খালি জায়গা। বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিং (আফতাবনগর) ব্লক-ই, সেকশন-৩-এর খালি জায়গা। কাওলা-শিয়ালডাঙ্গা সংলগ্ন খালি জায়গা এবং উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের উত্তরার স্লুইসগেট হতে কামারপাড়া ব্রিজ পর্যন্ত ফাঁকা জায়গা।