ক্লিন ইমেজ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার প্রথম শর্ত ?

শোকাবহ আগস্ট। বাংলার মানুষের চোখে জল। চিরন্তন কায়ক্লেশে কপোল বেয়ে অশ্রু। চলমান শ্রাবণের জলকেও ছাপিয়ে যাওয়া। ডুকরে ডুকরে কেঁদে ফেলার অনিবার্য বাস্তবতা। জাতির জনক ও তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে হায়েনারা হত্যা করার মধ্য দিয়ে জানান দিয়েছিল, প্রতিবিপ্লব এভাবে করতে হয়। সেই অশুভ আত্মারা আজও অযাচিত প্রেক্ষাপট প্রত্যাশী। যেন শকুনের মত করে অপেক্ষারত ! লাশের মাংশ ভক্ষণ করবে বলে ! আগষ্ট এলেই তাঁদের শারীরিক ভাষা বদলেও যায়।

এদিকে দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক অপশক্তি মোকাবেলায় আদৌ কি সফল ? —-এমন প্রশ্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। বিশেষত, দলের সাধারণ সম্পাদক পদে থেকে সাংগঠনিক দক্ষতায় শ্রেষ্ঠ ভুমিকা রাখা যাচ্ছে কিনা ? একজন অদম্য নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে তাল মিলিয়ে বৈশ্বিক ও দেশি অপশক্তি মোকাবেলায় পেরে ওঠা যাচ্ছে কিনা ? —- এমন অযুত জিজ্ঞাসা দলের তৃনমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও।

সূত্রমতে, তেমন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষিতই তো হালে সৃষ্টিই হয় নাই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরই যেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি কে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি প্রতিদিনই মুখ খুলতে অভ্যস্ত। এবং, তিনি সারাটা দিনই বিএনপি কে নিয়ে কথা বলেন। বাস্তবতা উঁকি দিয়েও তো বলে না, বিএনপি রাজনৈতিক ময়দানে সোচ্চার রয়েছে। না, তাঁদের কোন পর্যায়ের আন্দোলনও দৃশ্যমান নেই। মূলধারার রাজনীতি থেকে সরে যেয়ে গেল তের বছরে রাজনৈতিক অপশক্তির মত করে ওত পেতে থাকার একটা চেষ্টা তাদের। সঙ্গত যুক্তিতে মুলত বেশ কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্ব সাংগঠনিক বিচারে পরীক্ষিত নয়, তা অনুমিত।

প্রসঙ্গত, দ্বিদলীয় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের খেসারতে দেশে ২০০৭ সালে এক এগারোর মত পরিস্থিতিকে আলিঙ্গন করতে হয়েছিল। সে সময়ে ক্লিন ইমেজের দুই বরেণ্য নেতা প্রয়াত জিল্লুর রহমান ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দৃঢ় চিত্তের মননশীলতা ও সৃজনশীল রাজনীতির মিশেলে আওয়ামী লীগের জাতকে অতি উচ্চতায় তুলে ধরতে তাঁরা সমর্থ হন। একদিকে সেনা সমর্থিত সরকারকে মোকাবেলা করা। অন্যদিকে দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলাকে টিকিয়ে রাখা। সৈয়দ আশরাফ নিজেকে পুনরায় প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন, যখন ২০১৩ সালের ৫ মে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে গর্জনের সুরে বলে ওঠেন, ঘরে ফিরে যান, নতুবা পরিণতি সুখকর হবে না।

সেই আওয়ামী লীগকে এখন কাঠখড় পোহাতে হচ্ছে না। বিরোধীতা করে রাজনীতি করার ফলত প্রতিপক্ষ নেই। নেই সংসদেও। নেই রাজপথেও। তবে রাজনৈতিক অপশক্তি বসে নেই। তৃণমূল পর্যায়েও হোমওয়ার্ক আছে, চলছে। তারা জঙ্গিদের মত করে ২০২৩ সালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পেশাজীবী জনশ্রেণিদের ওপর আক্রমণ করে লাশ আর লাশ দেখতে চায়। তাঁরা মনে করে, এভাবেই আমরা কেবল রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে সফল হতে পারি। দলীয়ভাবে তাঁরা আওয়ামী লীগকে ভয় পাচ্ছে না। প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা মানুষগুলো ভয় পেলেই রাস্তায় নেমে সফল হওয়া যাবে। যা ইচ্ছে করতে হবে —-এমন অভিপ্রায়ে লন্ডনভিত্তিক এক রাজনৈতিক নেতার প্রাত্যহিক ব্রিফিং চলছে তা কথিত আছে।

প্রশ্ন হল, আওয়ামী লীগের মধ্যকার সেই সেনাপতি বিদ্যমান আছে কিনা, যিনি সৈয়দ আশরাফের মত ক্রাইসিস ম্যান হয়ে সব কিছু রুখে দিতে পারবেন ?

যেকোন উচ্চ মার্গের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মৌলিক গুনাবলির মধ্যে সততা, দক্ষতা, দেশপ্রেম ও দূরদৃষ্টি ও চরিত্র থাকতে হয়। আওয়ামী লীগের হয়ে যারা সাধারন সম্পাদক অতীতে হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যকের মধ্যে এই সকল গুণাবলিগুলো বিদ্যমান ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমেদ কিংবা এ এইচ এম কামারুজ্জামানও ছিলেন, ছিলেন সৈয়দ আশরাফের মত নির্লোভ সত্তার চরিত্রও। কিন্তু, বর্তমান সময়ে তেমন বনেদী ও ক্লিন ইমেজধারী নেতার দলের মধ্যকার সাংগঠনিক বলয়ে অংশগ্রহণ রয়েছে কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। বিশেষ করে, খুবই অস্বাস্থ্যকর অভিরুচীতে যেয়ে যখন আওয়ামী লীগের খোদ অনেক নেতাকেই আসন্ন ২২-তম সম্মেলন ঘিরে সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে দৌড়ঝাপ করতে দেখা যাচ্ছে।

দৌড়ঝাঁপ করার প্রথম নামটি হল জাহাঙ্গির কবীর নানক। যার দরাজ কন্ঠের সম্বলটি হালে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। তিনি যখন বক্তৃতা করেন, তা স্পষ্ট বচনে প্রতিভাত হয় না। দ্বিতীয় নামটি সূত্রমতে বাহাউদ্দীন নাসিম। তবে অত্যন্ত সজ্জন চরিত্রের এই নেতার এখনো পরিণত না হতে পারার দিকটি প্রকটিত হয়। দৌড়ঝাঁপ না করলেও সাধারণ সম্পাদক হওয়ার মিছিলে যাদের নাম রয়েছে তাঁদের মধ্যে রয়েছে, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক, মাহবুব উল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ, আব্দুর রহমান ও দীপু মনি। এছাড়াও খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বর্তমানে দলের দুই সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ ও মির্জা আজমও ভৌতিক প্রেক্ষাপটে আগ্রহীদের মধ্যে নাম ঢুকিয়েছেন বলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সাক্ষ্য দিচ্ছে।

আলোচনা আছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বজনখ্যাত দুই নেতার নামেও। একজন ব্যারিষ্টার ফজলে নূর তাপস। অন্যজন, নূর ই আলম চৌধুরী।

অপরদিকে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ধারাভাষ্যকার ও বিদগ্ধশ্রেণি তাঁদের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করতে যেয়ে বলছেন, জাতীয় স্বার্থ, শেখ হাসিনার প্রতি আনুগত্য, দলের প্রতি কমিটমেন্ট এবং ক্লিন ইমেজকে বড় করে দেখতে চাইলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন কে জোর করে এই পদে নিয়ে আসা উচিত। যিনি রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এর মেয়র। পিতা জাতীয় নেতা এ এইচ এম কামারুজ্জামানও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এমনিতে চাউর আছে, প্রত্যেকবার সম্মেলনের এক সপ্তাহ আগে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক পদে কে ভাল হতে পারেন, তাঁর একটি ইঙ্গিত, বার্তা আঙ্গিকে শেখ হাসিনা দিয়ে দেন। তবে তিনি গণতান্ত্রিক পছন্দে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হোক, সেটিও প্রত্যাশা করেন।

সাংস্কৃতিক মনোবোধের সাথে রাজনৈতিক সুবোধের একটা সু সমন্বয় আওয়ামী লীগ আজীবন রক্ষা করে গেছে। আজকের বর্তমান সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন ২০১৬ সালে সাধারণ সম্পাদক হন, দলের চাহিদা পূরণ করে নিজ যোগ্যতায় তিনি উত্তীর্ণ হন। সময় বলবে, দলের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ নেতাটি কে ! কারণ, আওয়ামী লীগে রাতারাতি পদ নিয়ে বড় নেতা হওয়া যায় না। ধারণা করা হচ্ছে এবং দলিয় সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, আসন্ন ডিসেম্বরের সম্মেলনে সভানেত্রী হিসাবে জীবন্ত কিংবিদন্তী শেখ হাসিনাই বহাল থাকবেন। দলের বর্তমান একাশি সদস্যের কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিষয়ভিত্তিক সম্পাদক পদে কিছু কিছু নেতা দীর্ঘদিন ধরে আছেন। তাঁদের অনেকে এবার বাদ পড়তে পারেন।

সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম কে বাহাউদ্দীন নাসিম বলেছেন, আগামী বছরের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং রাজনৈতিক অপশক্তি রুখতে একজন কার্যকর সাধারণ সম্পাদককেই দল বেছে নিবে।

অন্যদিকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রাজ্জাক দলিয় সভানেত্রীর কোর্টে বল ঠেলে দিয়ে গণমাধ্যম কে বলছেন, শেখ হাসিনা সম্মেলন নিয়ে কাজ করছেন। এমন বক্তব্যে দলের মধ্যে গণতন্ত্র আছে কি না, নতুন প্রশ্ন চলে আসে।

ক্লিন ইমেজ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষ চরিত্র হতে হলে আবশ্যক, ইতিহাস তেমন ধারাভাষ্য দেয়। ঢাকামুখী রাজনৈতিক পদারচনার মধ্য দিয়ে যারা নিজেদের জাতীয় নেতা বলতে স্বস্তিতে থাকছেন, আদৌ মানের বিচারে তাঁরা আওয়ামী লীগের মত দলকে শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করার মানদণ্ডে থাকা রাজনীতিকবর্গ তো ? বৈশ্বিক দূতিয়ালিতে তাঁরা সিদ্ধহস্ত সত্তা হতে পেরেছেন কি ? দুর্নীতি, প্রবাসে সেকেন্ড হোম ও সম্পদ অর্জনে বর্তমান ৮১ সদস্যের কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিষয়ভিত্তিক সম্পাদক পদে কিছু কিছু নেতা দীর্ঘদিন ধরে আছেন। তাঁদের অনেকে এবার বাদ পড়তে পারেন। র পথে তাঁরা পথিক নয় তো ? হরেক রকমের নৈতিক প্রশ্নের উত্তরটা শেখ হাসিনার কাছেই থাকবে।

বিশেষ সূত্র বলছে, তিনি দলের নীতি নির্ধারণী সদস্যদের খুব সহসায় ডেকে বলবেন, গা ধোয়া মেধাবী নেতাদের তালিকা প্রদান করুন। প্রয়াত প্রখ্যাত আইনজীবি ব্যারিষ্টার রফিকুল হক একবার বলেছিলেন, “গোষ্ঠিগত, জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রনায়ক হতে চাইলে পরিচ্ছন্ন মনের শরীর ধোয়া ব্যক্তি বিশেষের প্রয়োজন।” আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা তেমনই এক সত্তা—— নিশ্চয়ই পেছনের পৃষ্ঠাও বলবে, ক্লিন ইমেজের সৎ সত্তাধারী মানুষটিই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে যাচ্ছেন।