খাগড়াছড়িতে সদ্য প্রয়াত ইউপিডিএফ – এর কেন্দ্রীয় সদস্য দেবদন্ত ত্রিপুরা’র স্মরণসভা অনুষ্ঠিত
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সদ্য প্রয়াত ইউপিডিএফ’র কেন্দ্রীয় সদস্য দেবদন্ত ত্রিপুরা’র স্মরণসভা করেছে ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)।
বুধবার(৭ই জুন ২০২৩) সকাল খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নে জোরমরম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে এ স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে দেবদন্ত ত্রিপুরার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে।
“যে জীবন জাতি ও জণগনের জন্য উৎসর্গীকৃত তার মৃত্যু নেই” এই শ্লোগানে সকাল ৮টায় অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে স্মরণসভার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বিশেষ চৌকস টিমের মাধ্যমে অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করেন ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ইউপিডিএফ—এর খাগড়াছড়ি সদর ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়ক অংগ্য মারমা। এতে শোকার্ত পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করেন দেবদন্ত ত্রিপুরার সহধর্মিনী জীবিকা ত্রিপুরা ও বড় কন্যা পিপাসা ত্রিপুরা। এছাড়া শিশু—কিশোরসহ এলাকার আপামর জনসাধারণ দেবদন্ত ত্রিপুরার স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সর্বস্তরের জনসাধারণের পক্ষ থেকে অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে দেবদন্ত ত্রিপুরার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। পুষ্পস্তবক অর্পন শেষে সদ্য প্রয়াত ইউপিডিএফ এর কেন্দ্রীয় সদস্য দেবদন্ত ত্রিপুরাসহ পূর্ণস্বায়ত্তশাসন অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আত্মোৎসর্গীকৃত সকল বীর সহযোদ্ধাদের স্মরণে ২মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
প্রয়াত দেবদন্ত ত্রিপুরার স্মরণে পালন করা হয়েছে। এরপর প্রয়াত দেবদন্ত ত্রিপরার স্মরণে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণসভা। এতে সভাপতিত্ব করেন ইউপিডিএফ’র খাগড়াছড়ি সদর ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়ক অংগ্য মারমা ও সঞ্চালনা করেন ইউপিডিএফ সংগঠক বিপুল চাকমা।
স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতি কনিকা দেওয়ান এবং স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য দেন ভাইবোনছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুজন চাকমা, ২৩৯নং ভাইবোনছড়া মৌজার হেডম্যান লিটন ত্রিপুরা, সুরেন্দ্র মাস্টার পাড়া কার্বারী কল্প রঞ্জন ত্রিপুরা, বিরাশি মুড়ার কার্বারী বর্ণকুমার ত্রিপুরা, জোরমরম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক উতরা ত্রিপুরা, প্রয়াত দেবদন্ত ত্রিপুরার সহধর্মীনি জীবিকা ত্রিপুরা ও বড় কন্যা পিপাসা ত্রিপুরা ।
স্মরণসভায় অংশগ্রহণকারীদেও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম খাগড়াছড়ি জেলার সহ—সভাপতি লিটন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন খাগড়াছড়ি জেলা আহ্বায়ক এন্টি চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি শান্ত চাকমা, ইউপিডিএফ বৃহত্তর গোমতি ইউনিটের সমন্বয়ক সুইমং মারমা প্রমুখ।
স্মরণসভায় দেবদন্ত ত্রিপুরার সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি শান্ত চাকমা। স্মরণসভায় পিতার স্মরণে বক্তব্য দিচ্ছেন দেবদন্ত ত্রিপুরার কন্যা পিপাসা ত্রিপুরা।
সভায় পিতার স্মৃতিচারণ করে দেবদন্ত ত্রিপুরার কন্যা পিপাসা ত্রিপুরা বলেন, সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে ঠিকই কিন্তু বাবাকে অসময়ে এভাবে হারাবো কখনো ভাবিনি। বাবার সৎচিন্তা আদর্শের কারণে বাবাকে সবাই ভালবাসতো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তাঁর আদর্শে অবিচল ছিলেন। তাঁর আদর্শ আমরা আজীবন লালন করবো।
আবেগময়ী স্মৃতিচারণে দেবদন্ত ত্রিপুরার সহধর্মীনি জীবিকা ত্রিপুরা বলেন, চির বিদায়ের শেষ মুহুর্তেও তিনি আন্দোলনের কথা বলতে ভুলেননি। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
ভাইবোনছড়া ইউপি চেয়ারম্যান সুজন চাকমা স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি আর দেবদন্ত দা একই ক্লাশে ছিলাম। ১৯৮৭সালে শরণার্থী যাওয়ার পর সে আমার থেকে এক ক্লাশ সিনিয়র হয়। শরণার্থী থেকে ফিরে ভাইবোনছড়া এলাকায় ১২টি গ্রাম নিয়ে গঠন করেছিলাম সাথী ক্লাব। এ ক্লাব গঠনে তার বিশেষ অবদান ছিলো। স্কুল বন্ধের সময়ে ক্লাব নিয়ে আলোচনার সময় তাঁর নেতৃত্বের গুনাবলি প্রকাশ পায় এবং তাকে ক্লাবের সম্পাদক পদ দেওয়া হয়।
স্মরণসভায় বক্তব্যে ভাইবোনছড়া ইউপি চেয়ারম্যান সুজন চাকমা আরো বলেন, ১৯৯৩সালে গুইমারায় সম্মেলনের সময় অর্থ না থাকার কারনে সম্মেলনে উপস্থিত হওয়া সম্ভয় নয় বুঝতে পেরে তিনি মংশি মারমা নামে মহাজনের কাছে দিনমজুরি করে অর্থ উপার্জন করেছেন এবং তিনি বিনা পারিশ্রমিকে অর্থ নিতে অস্বীকার করেছিলেন। বৃহত্তর সাজেকে দুর্গা মন্দির নির্মাণসহ সবসময় সৎ পথে থাকার উপদেশ দিতেন।
সুরেন্দ্র মাস্টার পাড়া কার্বারী কল্প রঞ্জন ত্রিপুরা বলেন, দেবদন্ত ত্রিপুরা আমার ভাগিনা হলেও তিনি রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর ছিলেন। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ভাইবোনছড়ার বিশেষ শাখায় দায়িত্ব পালনের সময় আমাদেরকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়ার জন্য বলতেন। তিনি বলতেন জনগণের জন্য কাজ কর, জনগণ একদিন নিশ্চিত স্মরণ করবে।
২৩৯নং ভাইবোনছড়া মৌজার হেডম্যান লিটন ত্রিপুরা বলেন, দন্ত দা বিদ্যাবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। আমরা হারিয়েছি একজন সমাজ নেতাকে, একজন অভিভাবককে। তার দিক—নির্দেশনায় আমরা আমাদের সমাজকে সাজিয়েছি। তিনি যেখানে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানে উন্নয়নমূলক কাজ করার চেষ্টা করেছেন। তার জীবদ্দশায় জোরমরম এলাকায় সুরেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয় এবং কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরকম সমাজ হিতৈষী অভিভাবক আমাদের সমাজে পাব কিনা জানি না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কনিকা দেওয়ান বলেন, দেবদন্ত ত্রিপুরা যে আদর্শ আজীবন লালন করেছেন তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ব্যক্ত করেছেন। আমরা তার আদর্শিত পথে সহযাত্রী হিসেবে তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে লড়াই চালিয়ে নেওয়ার উৎসাহ উদ্দীপনা পেয়েছি। তিনি তার জীবন—যৌবন জাতির জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। তার এ চেতনা সমাজে ধারন করে দেবদন্ত ত্রিপুরার মত আপোষহীন নেতা আমাদের সমাজে গড়ে তুলতে হবে।
তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে নিরাপত্তা রক্ষার নামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী পাহাড়ি ধ্বংসের নীলনক্সায় মত্ত রয়েছে। গত ০৫ই জুন পানছড়ি ধুদুকছড়ায় বিজিবি কর্তৃক পাহাড়িদের গরু লুটের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে, তবে এতে এলাকার জনগণ প্রবল প্রতিরোধের মাধ্যমে যোগ্য জবাব দিয়েছেন। এরকম অহরহ ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে। পাহাড়ে নারী নিপীড়নের মতো ঘটনাও ঘটে চলেছে। এরকম নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
বিরাশি মুড়ার কার্বারী বর্ণ কুমার ত্রিপুরা বলেন, সুরেন্দ্র মাস্টার পাড়ায় মহোৎসব চলার সময় দেবদন্ত ত্রিপুরা সাথে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, জাতির অস্তিত্ব সংকটে আমাদের জাতির জন্য চিন্তা করতে হবে। জনগণের জন্য কাজ করলে জনগণ অবশ্যই একদিন স্মরণ করবে। অষ্টম শ্রেনীতে পড়ার সময় আমার বই কেনার সামর্থ ছিল না, তার মাধ্যমে আমি একসেট বই পেয়েছিলাম।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক উতরা কুমার ত্রিপুরা বলেন, দন্ত আমার ছাত্র ছিল এবং আমার খুব স্নেহের ছাত্র ছিলো। আমি তাকে প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়েছি। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় মানুষের ভীড়ের কারণে ফুল দিতে পারিনি। আজ তার স্মরণসভায় তাকে ফুল দিতে পেরে আমি অত্যন্ত গর্বিত।
স্মরণসভায় পাঠের জন্য লিখিত বক্তব্য পাঠান সাজেকের মাচলং উচ্চ বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। লিখিত বক্তব্যে তারা উল্লেখ করেন, দেবদন্ত ত্রিপুরা যখন সাংগঠনিক কাজে সাজেকে অবস্থান করছিলেন তখন সাজেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব ছিল। শত শত শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের অভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিলো। ২০১৩সালে মাচলং নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় তারই প্রত্যক্ষ তত্ত্বাধানে নির্মিত হয়েছিল। তার সুদুরপ্রসারী চিন্তার ফলে বৃহত্তর সাজেকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়েছে।
স্মরণসভার সভাপতি ও ইউপিডিএফ সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, আজ এমন পরিস্থিতিতে আমরা স্মরণসভা করছি যেসময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেবদন্ত ত্রিপুরা আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মৃত্যুশয্যায়ও তার দায়িত্ব পালনে তিনি অবহেলা করেননি, উপদেশ দিয়ে গেছেন।
অংগ্য মার্মা স্মৃতিচারণ করে আরো বলেন, দেবদন্ত ত্রিপুরা মানিকছড়িতে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের সময় মানিকছড়িতে ভূমি বেদখল বিরোধী একটি সমাবেশ আয়োজন করা হলে সমাবেশের একদিন আগে সেনাবাহিনী সমস্ত গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়। দেবদন্ত ত্রিপুরার তড়িৎবুদ্ধিতে সে কর্মসুচি সেনাবাহিনীর বাধার মুখে সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়। সমাবেশে ব্যবহৃত মাইকের ব্যাটারি সেনারা কেড়ে নিতে চাইলে সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।
তিনি দেবদন্ত ত্রিপুরার লালিত আদর্শ ও চিন্তা—চেতনা ধারণ করে এবং শোককে শক্তিতে পরিণত করে আগামী দিনের লড়াই সংগ্রামকে বেগবান করতে পার্টির কর্মী, সমর্থকসহ সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ১লা জুন ২০২৩ খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের সুরেন্দ্র মাস্টার পাড়ার নিজ বাড়িতে প্রয়াত হন দেবদন্ত ত্রিপুরা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন