খাগড়াছড়িতে সকল সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উৎসবমুখর পরিবেশে ফুল বিঝু পালন
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে সকল সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উৎসবমুখর পরিবেশে ফুল বিঝু পালন করেছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠি। বিগত বছরের সমস্ত দুঃখ, গ্লানি মুছে দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে পাহাড়ে পাহাড়িয়া ও বাঙ্গালিরা আনন্দে মেতেছে বৈসু-সাংগ্রাই-বিঝু ও বাংলা নববর্ষের উৎসবে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় বর্ষবিদায় ও বরণ উৎসব। যা ‘বৈ-সা-বি’ নামে পরিচিত।
বাংলা বর্ষের শেষ দিনে চাকমারা ‘ফুল বিঝু’, ত্রিপুরা স¤প্রদায়েরা ‘হাঁরিবৈসু’ আর মারমা স¤প্রদায়ে ‘সূচিকাজ’ নামে পালন করে যা ‘ফুল বৈসু/ফুল বিঝু নামে সর্বাধিক পরিচিত। বুধবার(১২ই এপ্রিল) ভোর সকালে উত্তর খবংপুড়িয়া চেঙ্গী নদীতে হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে মুখরিত ছিল। এ ফুল বিঝু/বৈসুর দিনের চেঙ্গী পাড়ে ত্রিপুরা, চাকমা, মারমা ও বাঙ্গালি স¤প্রদায়ের নিজ নিজ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে ফুল দিয়ে গঙ্গাদেবীকে প্রণাম জানাতে আসেন।
এ সময় খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী, জেলা প্রশাসক মো: সহিদুজ্জামান, জেলা পুলিশ সুপার মো: নাইমুল হক ও পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী, জেলা পরিষদের সদস্য কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া নদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
এর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বৈসাবি’র আয়োজন। জলে ফুল দেয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে এই উৎসব। পাহাড়ে ১৪ই এপ্রিল মারমা উন্নয়ন সংসদ সদর উপজেলা শাখা উদ্দ্যোগে র্যালী শোভা যাত্রা শেষে মারমা স¤প্রদায়ের ‘জলকেলি’র উৎসব আয়োজন করবে।
বুধবার সকালে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে জলে নানান রঙের ফুল দিয়ে প্রণাম উদযাপিত হয় ফুল বিঝু। এ সময় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে উপস্থিত পাহাড়ি তরুণ-তরুণীরা, তার পাশাপাশি অন্যান্য স¤প্রদায় তথা বাঙ্গালি সম্প্রদায়েরাও এই উৎসবে মাতোয়ারা।
এদিন পাহাড়িদের ঘরে ঘরে চলবে পাঁচন/মুই পাঞ্চালির আতিথেয়তা। এ দিন ফুল বিঝুর দিনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা বয়সী পাহাড়িরা ফুল নিয়ে আসতে শুরু করে বিভিন্ন ঘাটে। খুব ভোরে মা গঙ্গার উদ্দেশে নদীতে পবিত্র এই ফুল দিয়ে প্রণাম জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই উৎসব। উৎসবে নারীরা বাহারি রঙের ঐতিহ্যবাহী রিনাই-রিসা,পিনোন হাদি পরে আর ছেলেরা ধুতি, পাঞ্জাবি/ফতুয়া পরে চেঙ্গী নদীতে ফুল দিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরনো বছরের সব গ্লানি মুছে গিয়ে নতুন বছর বয়ে আনবে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি এমনটাই প্রত্যাশা সকলের। ফুলবিঝু নানান আয়োজনে উপস্থিত বিশিষ্টজনরাও জানালেন নিজেদের উচ্ছাস, আকাঙ্খা ও প্রত্যাশার কথা।
পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরনো বছরের দুঃখ বেদনাই যেন ভাসিয়ে দিয়ে নতুন দিনের সম্ভাবনার আলো জ্বালায় পাহাড়ের মানুষ। পুরনো দিনের বেদনা ভুলে নতুন দিনের প্রত্যয়ের কথা জানায় ফুল দিতে আসা পাহাড়ি তরুণ-তরুণীরা।
জেলা শহরের খবং পড়িয়াস্থ চেঙ্গী নদীতে ফুল দেয়ার সময় চাকমা স¤প্রদায়ের এক প্রতিনিধি জানান, এটি পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের ঐহিত্যবাহী সামাজিক উৎসব। পুরাতন বছরের সকল দুঃখ, গ্লানিকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরে জগতের সবাই যেন সুখে, শান্তিতে এবং আনন্দের সাথে কাটাতে পারি সেই প্রার্থনা করা হয় মা গঙ্গা দেবীর কাছে। সুন্দর পৃথিবী যেন ভালো হয়ে ওঠে এমনাটাই প্রত্যাশা।
চৈত্র মাসের শেষ দিনকে চাকমা স¤প্রদায়েরা বলি মূল বিঝু। এর আগের দিনকে ফুল বিঝু, আর পহেলা বৈশাখ পরিচিত গোজ্যেপোজ্যে/গজ্জ্যা পুজ্জ্যা দিন হিসেবে। এ দিন কেউ কোনো কাজ করে না, পাড়ায় ঘুরে ঘুরে, খেয়ে দেয়ে দিনটি পার করে থাকে।
বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিন বৈসু পালন করা হয়। চাকমা সম্প্রদায়ে বিঝু আদিকাল থেকেই চলে আসছে। বিঝুমানে আনন্দ, হইহুল্লোড়, বিঝু মানে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো। বিঝু মানে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করা, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা, সর্বোপরি বিজু মানে হলো মিলনমেলা। ঠিক তেমনি বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিন বৈসু পালন করা হয়। ত্রিপুরা ও মারমা স¤প্রদায়ে বৈসু-সাংগ্রাই আদিমকাল থেকেই চলে আসছে।
বৈসু –সাংগ্রারাই মানে আনন্দ, হইহুল্লোড়, বৈসু-সাংগ্রাই মানে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো। বৈসু-সাঙগ্রাই মানে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করা, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা, সর্বোপরি বৈসু-সাংগ্রাই মানে হলো মিলনমেলা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম এই সামাজিক আয়োজনে ব্যস্ততম এখন শহর, নগর আর পাহাড়ি গ্রাম গুলো। বাংলা বর্ষ বিদায় ও বরণ উপলক্ষে ত্রিপুরারা বৈসুক/বৈসু, চাকমারা বিঝু, মারমারা সংগ্রাই, সাওতালরা পাতা এভাবে তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে আলাদাভাবে পালন করে এই উৎসব। উৎসবের প্রথম দিনে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা ফুল আর নিমপাতা দিয়ে ঘর সাজায়। বৃহষ্পতিবার(১৩ই এপ্রিল) ত্রিপুরা স¤প্রদায়েরা গঙ্গাদেবীকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে।
নদীতে ফুল দেয়ার মাধ্যমে মঙ্গল কামনার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের জাতীয় ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক উৎসব বৈ-সা-বি(বৈসু-সাংগ্রাই-বিঝু-সাংক্রান-বিষু-বিহুৃ)। সকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে লোকজন নিজ নিজ জাতীয় পোষাক পরিধান করে অনেকে র্যালি সহকারে ও অনেকে উদ্যোগে নদীতে-ছড়ায় ফুল দিয়ে উৎসবের সূচনা করেন।
এদিকে বৈসাবি উপলক্ষে ১৬এপ্রিল রোববার খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহাসিক মর্মসিংহের বলি খেলা অনুষ্ঠিত হবে।
“আমাদের বৈসু,আমাদের আনন্দ ” প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বৈসু ও বিসিকাতাল উপলক্ষে জেলার কৃতি সন্তান, চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক জব্বারের বলি খেলায় চ্যাম্পিয়নস এবং জাতীয় কুস্তি দলের প্রাক্তন খেলোয়ার মর্মসিংহ ত্রিপুরা বলি খেলা ও সপ্তাহব্যাপি ত্রিপুরাদের অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার উদ্বোধন করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টার খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা পশ্চিম গোলাবাড়ী এলাকাবাসীর উদ্যোগে বৈসুর নতুন চমক হিসেবে এই ঐতিহ্যবাহী বলি খেলা অনুষ্ঠিত হবে। বলি খেলাটি আগামী ১৬ই এপ্রিল বিকেল ৩টায় ঠাকুরছড়া গোলাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। এ বলি খেলায় জেলা থেকে সকল বলি খেলোয়ারেরা অংশ নিতে পারবেন। সকল দর্শনার্থীদের জন্য এ খেলা উন্মুক্ত থাকবে এবং উপভোগ করতে পারবে। বৈসু উপলক্ষে আরও নানান ধরনের সপ্তাহব্যাপী খেলাধুলার প্রতিযোগিতা চলমান রয়েছে। এ খেলায় রয়েছে ত্রিপুরাদেও সুকুই খেলা, থাইলি বফাং কানাই খেলা, হতাখুম রমনাই, চপ্রিং, বৌদক সলনাই খেলাসহ বিভিন্ন ধরনের ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী খেলা।
সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন খেলার উদ্বোধনকালে পশ্চিম গোলাবাড়ীর বৈসু ও বিসিকাতাল উদযাপন কমিটির আহবায়ক খগেন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, আমাদের এলাকাবাসীর উদ্যোগে প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরেও বৈসু ও বিসিকাতাল উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলাসহ মানবিক কার্যক্রমও হাতে নিয়ে থাকি। প্রতি বছর এই উৎসবের দিনে সবাই যেন হাসি আনন্দে মেতে উঠি একিসাথে।
এলাকাবাসী সবাই মিলে, সবাইকে নিয়ে আমরা এই বৈসুতে হাসি-আনন্দ ভাগাভাগি করে থাকি। এ বছর একটু ব্যতিক্রমভাবে আমরা ঐতিহ্যবাহী মর্মসিংহ বলি খেলার আয়োজন করেছি। সকলকে এ বলি খেলা উপভোগ করার জন্য আহবান জানান তিনি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন