খালেদা জিয়াকে ভুলে গেছে বিএনপি!

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাসের ৩৮৭ দিন আজ। নানা রোগ-শোকে আক্রান্ত ৭২-ঊর্ধ্ব সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে নিয়ে এখন ভাবনা নেই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। নেই রাজপথের কোনো কর্মসূচি। এর আগে কিছু মানববন্ধন ও ঘরোয়া কর্মসূচি দিয়েছিল দলটি। তাও এখন নেই। এত দিনেও রাজপথের ‘শক্ত’ কোনো কর্মসূচিতে যাননি বিএনপির হাইকমান্ড।

খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে গিয়েছিল বিএনপি। খালেদার মুক্তি আন্দোলনের কিছুই হয়নি। এসব নিয়ে ক্ষুব্ধ বিএনপির তৃণমূল নেতৃত্ব। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুক্তিতে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা রাজপথের ‘কঠোর’ কর্মসূচি চান। জাতীয় নির্বাচনে ভোটের অনিয়ম নিয়ে সাম্প্রতিক গণশুনানিতে তৃণমূল নেতারা এমন আভাস দেন।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়ার মুক্তি সম্ভাবনা কম। তাই আমাদের রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমেই দেশনেত্রী বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। তবে কী ধরনের কর্মসূচি আসবে তা এখনই বলা সম্ভব না। দল পুনর্গঠন করে আন্দোলনে যেতে হবে।’

সূত্র জানান, খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে অনেকটা নীরব বিএনপির হাইকমান্ড। সবাই শুধু বক্তৃতা-বিবৃতিতে বেগম জিয়ার মুক্তি চাইছেন। বাস্তবে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত দলের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা। এরই মধ্যে বিএনপি নেতারা নানা ইস্যুতে পরস্পরকে দোষারোপ করছেন। একজন আরেকজনকে বিএনপির শত্রু হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। এক ধাপ এগিয়ে সরকারের ‘দালাল’ বলেও ‘আখ্যা’ দেওয়া হচ্ছে। দল গোছানোর উদ্যোগও নেই। তবে অঙ্গসংগঠনের কমিটি করার চেষ্টা চলছে।

এরই মধ্যে ঘোষিত দুটি অঙ্গসংগঠন ও দুটি পেশাজীবী সংগঠনের কমিটি নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, ‘অঙ্গসংগঠনের কমিটি আমরা পত্রিকায় দেখেছি। কখন কীভাবে কারা কমিটি দিচ্ছেন কিছুই জানি না।’

তৃণমূলের এক অঙ্গসংগঠনের নেতা জানান, সম্প্রতি তাকে বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা ঢাকায় ডেকেছিলেন। কেন ডাকা হয়েছে জানতে চাইলে বিএনপির ওই সিনিয়র নেতা তাকে বলেন, ‘তোমাকে কমিটিতে রাখা হবে।’ তৃণমূল নেতার উত্তর ছিল, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের কর্মসূচি দিন, তবেই ঢাকা যাব। খালেদা জিয়া যত দিন জেলে থাকবেন তত দিন আমি কোনো কমিটিতে পদ-পদবি চাই না। ম্যাডামের মুক্তির জন্য হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিন।’

এরপর কেন্দ্রীয় নেতা ফোন কেটে দেন। জানা যায়, বিএনপির একটি অংশ ভিতরে ভিতরে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানবিহীন নেতৃত্ব চায়। আরেক অংশ জিয়া পরিবার থেকেই বিএনপির নেতৃত্ব চায়। এ নিয়েও দলের ভিতরে ঠান্ডা লড়াই চলছে।

এদিকে দলের পুনর্গঠন চায় একটি অংশ। কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব চায়। কার্যত তারা মহাসচিব পরিবর্তন চায়। হাফডজন নেতাও ইতিমধ্যে মহাসচিব প্রার্থী হিসেবে জানান দিচ্ছেন। অবশ্য তারেক রহমানসহ বিএনপির বড় অংশই চান, বেগম জিয়ার মুক্তির আগে দল পুনর্গঠন নয়।

সম্প্রতি গণশুনানিতে অংশ নেওয়া তৃণমূল নেতাদের কণ্ঠেও ছিল ক্ষোভ। বেগম জিয়ার মুক্তিতে কঠোর কোনো কর্মসূচি না দেওয়ায় তারা ক্ষুব্ধও।

নোয়াখালী-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী সাবেক চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘আমি সবকিছু ভুলতে পারি, কিন্তু আমার মাকে (বেগম জিয়া) মুক্ত করার জন্য আপনারা কোন কর্মসূচি দিচ্ছেন না। কেন ৩১ ডিসেম্বর কোনো কর্মসূচি দেওয়া হলো না? সব নেতা-কর্মী উজ্জীবিত ছিলেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে মহাসচিবকে বলতে চাই, আর সহ্য হচ্ছে না।’

নরসিংদী-১ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী খায়রুল কবীর খোকন বলেন, ‘বেগম জিয়ার মুক্তি ছাড়া আমাদের নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হয়নি। এখন নতুন নির্বাচনের আগেই তাঁকে মুক্ত করতে হবে।’

পিরোজপুর-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘দেশমাতা খালেদা জিয়াকে মুক্ত না করতে পারলে এসব শুনানি করে তেমন কোনো লাভ নেই। এখন আমাদের একটাই কাজ, আন্দোলন, আন্দোলন আর আন্দোলন।’

পাবনা-৪ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, ‘গণশুনানি করে কী হবে জানি না, তবে আমাদের নেত্রী বেগম জিয়াকে মুক্ত করা ছাড়া আর কোনো নির্বাচনে যাওয়া যাবে না।’

এদিকে কারাগারে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বেশ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত। সম্প্রতি সরকার গঠিত মেডিকেল বোর্ড বেগম জিয়াকে দেখতে গিয়েছিলেন।

তারা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া রিউমেটিক আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অস্ট্রিও-আর্থ্রাইটিস, টানেল সিনড্রোম, ফ্রোজেন শোল্ডার, লাম্বার স্টোনাইসিস, থাইটিকা, ক্রনিক হাইপো নিথ্রেমিয়া ও কিডনি রোগে ভুগছেন। কয়েকটি রোগ আগে থেকেই ছিল। এগুলোর উন্নতি হয়নি। তাঁর নিয়মিত চিকিৎসা দরকার।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় গুলশানের বিএনপির চেয়ারপারসন কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় নেতারা কারাবন্দী বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

এ নিয়ে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, ‘খালেদা জিয়া যে রোগগুলোয় ভুগছেন তা অত্যন্ত মারাত্মক। তাঁর বয়স ৭৩-এর পথে। এ বয়সে এ রোগগুলোর যদি নিয়মিত চিকিৎসা না হয়, প্রতিদিন যদি মনিটর না করা হয়, তাহলে তাঁর জীবনের প্রতি মারাত্মক হুমকি এসে যেতে পারে। সরকার কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। গত সাড়ে তিন মাসে তাঁর কোনোরকম রক্ত পরীক্ষা, ব্লাড সুগার টেস্ট বা এক্স-রে করা হয়নি। তাঁর কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। সরকার বিএনপি চেয়ারপারসনকে ক্রমেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।’

খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে বিক্ষোভ : খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে গতকাল বিকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন দলের সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। মিছিলটি নাইটিঙ্গেলের দিকে এগিয়ে স্কাউট মার্কেট ঘুরে ফকিরাপুল অভিমুখে নয়াপল্টন মসজিদ ঘুরে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে এসে শেষ হয়।

এ সময় রিজভী আহমেদ বলেন, ‘সরকার আইন, বিচার, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ধ্বংস করেছে। গণমাধ্যমকে ভয়ভীতি ও চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে কব্জায় রাখার চেষ্টা করছে। সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে বলেই আমাদের রাজপথেই অবস্থান নিতে হবে। সরকার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই খালেদা জিয়াকে কারাগারে বন্দী করে রেখেছে।’

খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে উদ্বেগ : কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। তারা অবিলম্বে খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা চান। একই সঙ্গে তার মুক্তির বিষয়ে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি শিগগিরই রাজপথে আন্দোলনের কথাও চিন্তা করছেন দলটির নীতি-নির্ধারকরা। এ জন্য কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া যায় তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করেছেন তারা। তবে বৈঠকে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। গতকাল বিকালে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়।

স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, আমরা ইতিমধ্যে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি চেয়ে তাকে অবিলম্বে সুচিকিৎসা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা এখন এতটাই খারাপ যে, তিনি হাঁটতে পারছে না, কিছু ধরে রাখতেও পারছেন না।

এই মুহূর্তে তাকে সুচিকিৎসা দেওয়া সবচেয়ে আগে প্রয়োজন। এসব নিয়ে কী করা যায় তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া দেশনেত্রীর মুক্তির বিষয়ে আইনি লড়াইও চলবে। পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলনের জন্য কী কর্মসূচি দেওয়া যায় তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।