খুলনার কয়রায় অসাধু চক্রের সার সিন্ডিকেটের ব্যবসা রমরমা! দিশেহারা কৃষক
উপকূলীয় উপজেলা খুলনার কয়রায় কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি হচ্ছে। কয়েকটি পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রশাসন নড়েচড়ে বসলেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। কৌশল পরিবর্তন করে ম্যানেজ করে অব্যাহত রেখেছে সিন্ডিকেট ব্যবসা।
এদিকে যথেষ্ট প্রমাণ থাকার পরেও অজানা কারণে প্রশাসন ব্যবস্থা না নেওয়ায় হতাশ হয়েছে খুচরা বিক্রেতা ও কৃষকরা। খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি টাকায় ডিলার থেকে তাদের সার কিনতে হচ্ছে। এসব তথ্য ফাঁস করলে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয়। এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, খুলনা থেকে চিকন ইউরিয়া সংগ্রহ করতে বস্তাপ্রতি ৩০ টাকা বকসিস দিতে হয়।।
সরেজমিন উপজেলার কয়রা সদর, বাগালী ও মহারাজপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি সার বিক্রয় কেন্দ্র ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক সপ্তাহ পূর্বে ইউরিয়া ২৬/২৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২৪/২৫ টাকা, টিএসপি (টিউনেসিয়া) বিক্রি হচ্ছে ৩৩/৩৫ টাকা ও টিএসপি (মরক্কো) ২৪/২৫ টাকা। তবে সব দোকানে টিএসপি (মরক্কো) পাওয়া যাচ্ছে না। কতিপয় অধিক মুনাফা লোভী ব্যবসায়ি টিএসপি (মরক্কো) না বিক্রি করে টিএসপি (টিউনেসিয়া) এর মান ভালো ও সংকটের কথা বলে ২২ টাকার স্থলে চাষির কাছে ৩৩/৩৫ টাকায় বিক্রি করছে। এছাড়া চিকন ইউরিয়া ও মোটা ইউরিয়ার সরকার নির্ধারিত দর একই হলেও চিকনটি বিক্রি করছে ২৫/২৬ টাকা। ফলে কৃষকদের মাঝে সরকারি সারের প্রতি অনিহা ও নেগেটিভ ধারণারও সৃষ্টি হচ্ছে।
এসময় একাধিক খুচরা বিক্রেতারা জানান, “ডিলাররা আমাদের কাছ থেকে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ইউরিয়া ১১০০/ ১১২০ টাকা নিচ্ছে। ডিলার পয়েন্ট থেকে নিজেদের দোকানে আনতে ২০/৩০ ভ্যান ভাড়া লাগে। এরপরে অপচয়, ঘরভাড়াসহ আনুষঙ্গিক কিছু খরচ রয়েছে। সরকার নির্ধারিত দর ২২ টাকায় কেজি বিক্রি করতে গেলে প্রতি বস্তায় ৫০/৬০ টাকা পকেট থেকে যাবে। এছাড়া ডিলাররা খুচরা বিক্রেতাদের কোন সঠিক বিক্রি রশিদ দেন না। যেটা দেন তার চেয়ে তাদেরকে বেশি দাম দিয়ে সার সংগ্রহ করতে হয়। তারা বলেন, এসব বিষয়ে কৃষি কর্মকর্তারা সবই জানেন। তবে কোন সমাধান করেন না। আমরা প্রতিবাদ করলে উল্টো হয়রানির শিকার হই। আমরা নিরুপায় হয়ে পেটের দায়ে অন্যায়কে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। আর আনুষঙ্গিক খরচ তুলতে কিছুটা বেশি দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।
মহারাজপুর ইউনিয়নের অন্তাবুনিয়া বাজারস্থ গাজী স্টোরে যেয়ে দেখা যায়, সেখানে কোন টিএসপি(মরক্কো) নেই। ইউরিয়া বিক্রি করছেন ২৪ টাকা কেজি ও টিএসপি (টিউনেসিয়া) বিক্রি করছেন ৩৩ টাকা কেজি। তার এক বস্তা ইউরিয়া ও এক বস্তা টিএসপি (মরক্কো) কিনতে চাইলে তিনি বলেন, ইউরিয়া একবস্তা দেয়া যাবে না, কয়েক কেজি নিতে পারেন। আর টিএসপি নিতে পারেন তবে ১৬৫০ টাকা বস্তা পড়বে। সরকারি দরের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইউনিয়ন ডিলার আমাদের থেকে ইউরিয়া ১১২০ টাকা ও টিএসপি (টিউনেসিয়া) ১৫২৫ টাকা বস্তা নিচ্ছে। এরপরে প্রতিবস্তা নিজ দোকান পর্যন্ত আনতে ২০ টাকা খরচ হয়। ঘরভাড়াসহ অন্যান্য খরচতো রয়েছেই। তারপরে আমাদের সংসার চালাতে হয়। তবে ডিলার থেকে ক্রয় রশিদ দেখাতে বললে তিনি বলেন, আমাদের কোন ক্রয় রশিদ দেয়া হয় না।
বিষয়টি ঘটনাস্থালে দাঁড়িয়ে উপজেলা কৃষি অফিসারকে অবহিত করা হয়। তখন ওই খুচরা বিক্রেতাও প্রতিবেদকের মুঠোফোনের মাধ্যমে কৃষি অফিসারকে ডিলারের বেশি দাম নেওয়ার বিষয়টি জানান। ২ দিন অতিবাহিত হলেও ইউনিয়ন ডিলারের দাম বেশি নেওয়ার বিষয়ে কোন সদুত্তোর মেলেনি।
বামিয়া গ্রামের রুহুল আমিন নামের এক চাষি বলেন, কয়রায় সারের দাম বেশি থাকায় পাইকগাছা উপজেলার মৌখালী বাজার থেকে টিএসপি (মরক্কো) ১২০০ টাকা ও ইউরিয়া ১২৫০ টাকা বস্তা দরে সার কিনেছি। বাগালী ইউনিয়নের বিসিআইসি ডিলার ও উপজেলার ব্যবসায়িদের প্রতিনিধি আবুল হাসান বলেন, পরিবহন খরচ গাড়ি প্রতি বেড়েছে ৮/৯ হাজার টাকা। সারের দামও বেড়েছে। তবে আমাদের মুনাফার মার্জিন বাড়ানো হয়নি। পূর্বে বস্তা প্রতি ইউরিয়া সার পেতে ৭শ’ টাকা জমা দিতে হত, আর এখন জমা দিতে হয় এক হাজার টাকা। তখনও খরচ ও মুনাফা বাবদ ৮০ টাকা যুক্ত করে ৭৮০ টাকায় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত ছিল, এখনও সেই ৮০ টাকা যুক্ত করে দর বেঁধে দেয়া হয়েছে ১০৮০ টাকা।
ফলে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে ঘরভাড়া, কর্মচারীর মজুরীসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিটিয়ে আমাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে চরম হিমসিম খাচ্ছি। আমরা জেলা মিটিংয়ে এ বিষয়ে বিবেচনার অনুরোধ করেও কোন সিদ্ধান্ত পাইনি। আর সারের দাম বেশি নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আছাদুজ্জামান বলেন, উপজেলা পর্যায় হতে ইউনিয়ন পর্যন্ত সকল কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন। ডিলার হতে খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ে সার সরবরাহের সময় ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মকর্তার উপস্থিতি নিশ্চিত করা হচ্ছে যাতে করে খুচরা পর্যায়ে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খুলনার উপ-পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, বেশি দরে সার বিক্রির কোন সুযোগ নেই। সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ইউরিয়া ও টিএসপি উভয়ই ১১শ’ টাকা বস্তা। খুচরা বিক্রেতারা বিসিআইসি ডিলারদের থেকে কিনবেন প্রতি বস্তা ১০৮০ টাকায়।
সরেজমিন কৃষি অফিসারকে অবহিত করার পরেও কোন ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আপনার কাছে রেকর্ড থাকলে কৃষি অফিসারকে দেন, তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনবেন। আমি কৃষি অফিসারকে বলে দিচ্ছি। তবে কিছুক্ষণ পরে কল দিয়ে বলেন, আমি কৃষি কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বলেছি। তবে উনারা বলেছেন, লিখিত অভিযোগ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় আনা সম্ভব নয়। আপনি একটা লিখিত অভিযোগ করেন।
তবে মুঠোফোনে কয়েকবার কল করেও এ ব্যাপারে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন