‘চাল কিনতে গেলে সবজি কেনার টাকা থাকে না’

বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে লেখাপড়া শিখে চাকরি করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে। তাই দিনমজুর বাবা অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শেখান। এসএসসি পরীক্ষায় পাস করে ছেলে ছমির উদ্দীন সেনাবাহিনীতে চাকরি নেন। তবে বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটি না নিয়ে বাড়ি চলে আসায় চাকরি হারান তিনি। এরপর শুরু হয় তার কষ্টের জীবন।

এখন রাস্তায় বাদাম, জলপাই ইত্যাদি বিক্রি করে খেয়ে না খেয়ে চলে তার সংসার। একদিন কাজে বের হতে না পারলে সংসারে খাবার জোটে না। নিজের কোনো জমিজমা না থাকায় প্রায় দুই যুগ ধরে দিনমজুরের কাজ করেছেন ছমির উদ্দীন। সংসারে অভাবের কারণে তাকে ছেড়ে চলে গেছেন প্রথম স্ত্রী।

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাথুলি ইউনিয়নের গাড়াবাড়িয়া গ্রামের দিনমজুর মৃত সিফার উদ্দীন কারিগরের ছেলে ছমির উদ্দীন (৭০)। সিফার উদ্দীন কারিগরের বাবা মৃত মঙ্গল কারিগরও দিনমজুরের কাজ করতেন। দিনমজুরের কাজ করে যা রোজগার করেছেন তা দিয়ে কোনোমতো সংসার চালিয়ে গেছেন তারা। নিজেদের কোনো জমিজমা নেই।

ছমির উদ্দীনের দুই ছেলে ইব্রাহিম হোসেন (৩৫) এবং শহিদুল ইসলাম (৩১) বর্তমানে দিনমজুরের কাজ করেন। বড় ছেলে ইব্রাহিম হোসেন বাড়িতে জায়গা না হওয়ায় বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি থাকেন।

ছমির উদ্দীন বলেন, বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল আমি লেখাপড়া শিখে চাকরি করে ভাগ্য পরিবর্তন করবো। তাই দিনমজুর বাবা না খেয়ে অনেক কষ্ট করে স্কুলে পাঠান। ১৯৭৪ সালে মেহেরপুর যাদুখালী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করি। ১৯৮২ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেই। এর চার বছর পর বাবা মারা যান। বাবাকে শেষবার দেখার জন্য ছুটি না নিয়েই বাড়িতে চলে আসি। তখনই ঘটে বিপত্তি। আমাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তখন থেকেই দিনমজুরের কাজ শুরু করি।

তিনি জানান, প্রায় দুই যুগ দিনমজুরের কাজ করার পর তার মাজা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা শুরু হয়। বয়স বাড়ায় আগের মত মানুষ কাজে ডাকে না। একদিন কাজে কেউ ডাকলে সপ্তাহে বাকি পাঁচদিনই অনাহারে অর্ধহারে বসে থাকতে হয়। তাই তিনি রাস্তায় বাদাম, জলপাই ইত্যাদি বিক্রি করে বেড়ান। কোনোদিন বিক্রি কম হলে না খেয়ে রাত্রিযাপন করতে হয়।

ছমির উদ্দীন জানান, সারাদিন যা বেচাকেনা হয় তার থেকে লাভের টাকায় এক কেজি চাল কেনার পর সবজি কেনার জন্য আর টাকা থাকে না। তখন তিনি অন্যের কাছে থেকে সবজি চেয়ে নিয়ে আসেন খাওয়ার জন্য। আর বিক্রি কম হলে না খেয়ে রাত্রিযাপন করতে হয়।

ছমির উদ্দীনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আধা শতক জমির ওপর চার থেকে পাঁচটি টিনের কুঁড়েঘর। বারান্দায় একটি ছোট রান্নাঘর। ঘুপছি শোবার ঘর। ঘরে একটি ছোট চৌকি। ঘরের ভেতরে স্বাভাবিকভাবে উঠে দাঁড়ানো যায় না। বিভিন্ন মানুষের দেয়া জামা-কাপড়ই তারা ব্যবহার করেন। একটি স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিনও নেই তাদের। এখন পর্যন্ত চেয়ারম্যান, মেম্বার বা সরকারি কোনো কর্মকর্তা তাদের সহযোগিতা করেনি।

ছমির উদ্দীনের স্ত্রী বলেন, সরকারি সহযোগিতা অনেকেই পায়। আমাদের কপালে নাই। অভাবের কারণে ভালোমন্দ খেতে পারি না। এ জীবন থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। বাড়িওয়ালা কাজ করলে চুলা জ্বলে, না করলে জ্বলে না। কোনো রকমে বেঁচে আছি। এখন বয়স হয়েছে। মানুষজন কাজেও নিতে চায় না।

প্রতিবেশী জসিম উদ্দীন জানান, ওরা খুব অসহায়। ওদের দুঃখ-কষ্টের যেন শেষ নেই। কাজ করলে খাবার হয়, না করলে উপোস থাকতে হয়। গরিব মানুষের যেন কষ্টের শেষ নেই। তাদের বাড়ি নেই। থাকার ঘর নেই। রাস্তায় বাদাম, লবণ, জলপাই বিক্রি করে কোনোরকম জীবন পার করছেন। একই কথা বলেন প্রতিবেশী জাকির ও মিলন হোসেন।

গাড়াবাড়িয়া গ্রামের ইউপি সদস্য মহাব্বত হোসেন বলেন, ছমির উদ্দীনের বাবা দিনমজুর ছিলেন। ছমির উদ্দীনেরও ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বয়স্কভাতার কার্ড করতে গেলে আইডি কার্ডের ভুলের কারণে করা সম্ভব হয়নি। সামনে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো বরাদ্দ পাওয়া গেলে তাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেয়া হবে।

কাথুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান রানা বলেন, ছমির উদ্দীন খুবই গরিব এবং অসহায় মানুষ। তার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সব রকম সহযোগিতা করা হবে।