চির প্রতিদ্বন্দ্বি আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল: কার ঝুলিতে কী?
ইউরোপের সৃজনশীল ফুটবল খেলা সমর্থকদের চোখ শীতল করে। ইউরোপকে ঘিরে ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চ গড়ে উঠেছে।
কিন্তু ফুটবলে যখন ‘সমর্থন’ হিসাব করবেন, আর বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের কথায় আসবেন, তবে অবশ্যই আপনি ইউরোপ চাপিয়ে লাতিন আমেরিকায় চলে যাবেন। যেখানে ফুটবল সম্রাট আর রাজপুত্রের জন্মভূমি। হালের মেসি-নেইমার তো কোনো অংশেই কম নয়।
ইউরোপে আধুনিক ফুটবল শিল্পকে, শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে লিওনেল মেসির কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মনে রাখবে। নেইমারও তার অংশ।
১৯৬০-৭০-এর দশকে দুই পায়ের নিদারুণ কারুকার্যে এডসন আরান্তেস দো নসিমেন্তো পেলে ইউরোপে নয়, ফুটবলের সিংহাসন গড়েছেন লাতিন আমেরিকার ব্রাজিলে। ১৯৮০-৯০-এর দশকের দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা জাতীয় দল ও ইউরোপ কাঁপিয়ে রজপুত্র বনেছেন আর্জেন্টিনার হয়ে। তাইতো ইউরোপসহ সারা বিশ্বের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত আজ। কেউ সম্রাটের দেশ ব্রাজিলে থাকতে চান, কেউ রাজপুত্রের দেশ আর্জেন্টিনায়। বর্তমান সময়ে সে বাঁক মেসি-নেইমারকে ঘিরে। দু’দলের লড়াই যখন নিকটে, তাবৎ বিশ্ববাসী আবারো নড়েচড়ে বসেছে।
দীর্ঘ ১৪ বছর পর বড় কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে আবারো মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। মহামারি করোনার কারণে এবার হয়তোবা খোলা মাঠে টিভি টাঙিয়ে হলুদ-সাদা ও আকাশি নীলের সমর্থকদের একসঙ্গে হই-হুল্লোতে মেতে ওঠা কিংবা গোল বলে চিৎকার করা হবে না। পাড়ার দোকানে টেলিভিশনে চোখ রেখে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া এবার আর যাবে না প্রবীণ ভক্তদের। আনন্দের পারদ শুধুই আপন কক্ষ ছুঁয়ে যাবে। বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে কোপা আমেরিকা আমেরিকার ফাইনালে আগামীকাল ভোর ৬টায় মুখোমুখি হবে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা ও নেইমার জুনিয়রের ব্রাজিল।
ফুটবলের খুদে জাদুকর কিংবা ভিনগ্রহের এলিয়েন, জাতীয় দলের জার্সি গায়ে পাওনাশূন্য। অন্তত একটি শিরোপা কি মেসি প্রাপ্য নন? ছয়বারের ব্যালন ডি’অর জয়ীর সামনে নিজের পাওনা বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে আবারও। নেইমার তো মুখিয়েই আছেন সাবেক সতীর্থের মুখোমুখি হতে। প্রমাণ করার সময় ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টারেরও।
বড় টুর্নামেন্টে ভেনেজুয়েলায় অনুষ্ঠিত ২০০৭ সালে কোপা আমেরিকার ফাইনালই ছিল, দু’দলের শেষ কোনো ফাইনালে মুখোমুখি হওয়া। ম্যাচটি ৩-০ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা।
এবারের কোপায় এখন পর্যন্ত অপরাজিত দু’দল। দাপটের সঙ্গে গ্রুপ পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখে উভয় দল। কোয়ার্টারে ইকুয়েডরকে ৩-০ গোলে এবং সেমিতে কলম্বিয়ার বিপক্ষ টাইব্রেকারে গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজের বীরত্বে ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা। অপরদিকে ব্রাজিল শেষ আটে চিলির বিপক্ষে ১-০ এবং শেষ চারে পেরুর বিপক্ষে একই ব্যবধানের জয় নিয়ে ফাইনালে পা রাখে। নকআউটের দুই ম্যাচেই তিতের রক্ষাকবচ হয়েছিলেন লুকাস পাকুয়েতা। আসরে আর্জেন্টিনা ১১ গোলের বিপরীতে হজম করেছে তিনটি গোল। অপরদিকে ব্রাজিল ১২ গোল দিয়েছে, নিজেদের জালে নিয়েছে দুই গোল।
পূর্বের লড়াইয়ের পরিসংখ্যানও উনিশ-বিশে। সর্বমোট ১১১ বার মুখোমুখি হয়েছে দু’দল। যেখানে ৪৬ বার জিতে এগিয়ে আছে ব্রাজিল। আর্জেন্টিনার জয় ৪০ ম্যাচে। ২৫ শেষ হয়েছে সমতায়। শেষ ২০১৯ সালের ১৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল দু’দল, যেখানে ব্রাজিলকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল আর্জেন্টাইনরা। তবে শেষ পাঁচ দেখায় তিনবার সেলসাওরা ও দুবার অ্যালবিসেলেস্তে জয় পায়।
কোপা আমেরিকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪ বারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা শেষ শিরোপা জিতেছে ১৯৯৩ সালে। এরপর শিরোপা খরা। ২৮ বছরের শিরোপাহীন দলটির বিপক্ষে লড়বে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা কোপার শিরোপা জিতেছে ৯ বার।
কোপায় ১৯১৬ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে চ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হতো। একটি গ্রুপে যার পয়েন্ট সর্বোচ্চ হতো সেই বিজয়ী, দ্বিতীয় স্থানে থাকা দল রানার্সআপ। প্রতি ম্যাচের পয়েন্ট ছিল-২। সেই পদ্ধতিতে আর্জেন্টিনা ৭ বার ব্রাজিলকে পেছনে ফেলে সর্বোচ্চ পয়েন্ট নিয়ে বিজয়ী হয়। এর মধ্যে ১৯৩৭ সালে উভয় দলের পয়েন্ট সমান হওয়ায় একটি প্লে-অফ ম্যাচ হয় যাতে ব্রাজিলকে ২-০ গোলে পরাজিত করে অ্যালবিসেলেস্তেরা।
১৯৯১ সালে ১০টি দল অংশগ্রহণ করে। দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক গ্রুপে ৫টি করে দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।
আর্জেন্টিনা ‘এ’ গ্রুপ থেকে চ্যাম্পিয়ন ও চিলি রানার্সআপ হয়। গ্রুপ ‘বি’ থেকে কলম্বিয়া চ্যাম্পিয়ন ও ব্রাজিল রানার্সআপ হয়। পরবর্তিতে এই চার দল একটি গ্রুপে রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে একে অপরের মুখোমুখি হয়। যাতে আর্জেন্টিনা সর্বোচ্চ পয়েন্ট পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ও ব্রাজিল রানার্সআপ হয়। ২০০৪ ও ২০০৭ এ ব্রাজিল নকআউট পদ্ধতিতে আর্জেন্টিনা কে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয়। ২০০৪ সালে ফাইনালে জমজমাট লড়াইয়ে আর্জেন্টিনা এগিয়ে থাকলেও শেষ মুহূর্তের গোলে ব্রাজিল সমতায় ফিরে এবং টাইব্রেকারে ব্রাজিল ৪-২ গোলে জিতে যায়।
গত ২৮ বছরর ফাইনাল বলতেই যেন আর্জন্টিনার হার। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল জার্মানদের বিপক্ষে ১-০ গোলের হার। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে কোপার দুই আসরের ফাইনাল গোলশূন্য ড্র হওয়ার পর টাইব্রেকারে চিলির বিপক্ষে হেরে যাওয়। অপর দিকে গত আসরে ব্রাজিল ৩-১ গোলে পেরুকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
১৪ বছর পর আবারও মুখোমুখি হবে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। কে জিতবে এবার? ব্রাজিলের মাটিতে এর আগে পাঁচবার কোপার আসর বসেছিল। যার প্রত্যেকবার শিরোপা জিতেছিল তারা। ইতিহাস বলে, নকআউট সিস্টেমে আর্জেন্টিনা হারাতে পারে না ব্রাজিলকে। আর ব্রাজিলে কোপা হয়েছে অথচ তারা চ্যাম্পিয়ন হয়নি এমন ঘটনা কখনোই ঘটেনি।
কিন্তু এবার এমন ঘটনার বিপরীত কিছু যে হবে না, তা বলা মুশকিল। কারণ, বিপক্ষ দলে যে একজন লিওনেল মেসি রয়েছেন। এবারের কোপায় আর্জেন্টিনার ১১ গোলের মধ্যে ৯ গোলেই যা সরাসরি অবদান রয়েছে। ৪ গোলের পাশাপাশি পাঁচ অ্যাসিস্ট করে গোল্ডেন বুটের দৌড়ে রয়েছেন সবার আগে। শিরোপা নেশায় বিভোর এই জাদুকর যদি ফাইনালে জ্বলে ওঠেন, মারাকানা নদীর জলও হয়তো ধাবিয়ে রাখতে পারবে না। সঙ্গে আছেন কোপায় তিন ম্যাচে তিন গোল করা লাউারো মার্টিনেজ। ডি পল-পাপু গোমেজরাও গোলে আছেন। তবে কোচ লিওনেল স্কালোনির মাথাব্যথা থাকবে ডিফেন্স নিয়ে। নেইমারের ড্রিবলিং ট্যাকেল দিতে ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো ছিল তার অন্যতম ভরসা। তাকে ফাইনালেও না পাওয়ার সম্ভবনাই বেশি। ডি মারিয়াও ৯০ মিনিট খেলার জন্য ফিট নন।
অন্যদিকে নেইমারও রয়েছেন দারুণ ছন্দে। দুই গোলের পাশাপাশি তিন অ্যাসিস্ট। দুই গোল করা পাকুয়েতা ভালোই সঙ্গ দিচ্ছেন নেইমারকে। রিচার্লিসন, মার্কুইনহোস, ক্যাসিমিরোতো আছেনই। দু’দলের লাইনআপ ও ফর্ম রোমাঞ্চকর লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে। টানা ১৮ ম্যাচে অপরাজিত স্কালোনির আর্জেন্টিনা, তিতের ব্রাজিলও শেষ ১৩ ম্যাচে হারেনি। ফল যাই হোক ‘সুপার ক্লাসিকো’ তো আর সবসময় আসে না। উপভোগ করাই শ্রেয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন