চড়ুইভাতির স্মৃতি : কয়েকজন মুরুব্বী লাঠি নিয়ে তাঁড়া করেছিলেন

চড়ুইভাতি বা বনভোজনের ইতিহাস আমাদের বেশ পুরনো। একটা সময় গ্রাম্য আবহে চোখে পড়ত দল বেঁধে রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া। তার আগে সংগ্রহ করা হতো চাল-ডাল, কেউ দিত মসলাপাতি। বাড়ির উঠোনেই চলতো রান্নাযজ্ঞ। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই রান্নার ঘ্রাণে মৌ মৌ করত পুরো বাড়ি। তাতেই আনন্দে আটখানা হতো কচি-কাঁচার মুখ।পর্দার আড়ালে মা -চাচিরা সাহায্য করতেন । এটিই ছিল চড়ুইভাতি। বনভোজনে রান্না-বান্নাসহ যাবতীয় কাজে নিজেকে প্রণোদিত করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, বন্ধুরা মিলে ঘুরতে যাওয়া, স্কুল-কলেজের বার্ষিক আয়োজনসহ বনভোজনে অংশ নিয়েছিল এক ধরনের বিনোদন। আমি এ বিনোদন খুব আগ্রহ সহকারে উপভোগ করতাম ।

বনভোজনের অর্থ বঙ্গীয় শব্দকোষে এসেছে রন্ধনপূর্বক ভোজন। পরে অভিধানে বিস্তৃত বর্ণনায় বলা হয়েছে বন বা রম্য স্থানে গিয়ে সংঘবদ্ধ রন্ধন, প্রীতিভোজন। শীতে পাড়ার মানুষ একদিন তরিতরকারি চাল-ডাল নিয়ে কোথাও গিয়ে রান্না করে খাওয়ার আয়োজন করত। দল ছোট হলে জোগাড় করা হতো ডিম, মুরগি। আর বড় হলে হাঁড়িকুড়ি, চাল-ডাল সবজি ছোট খাসির গলায় দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো গায়ের বাইরে। বড় কোন গাছ তলায়। চুলা খুঁড়ে খড়ি জ্বালিয়ে শুরু হতো প্রাক রন্ধন পর্ব। একদল রাঁধতো, অন্য দল হৈ হুল্লোড় রং তামাশায় মেতে উঠত। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় আমাদের এলাকা পানিতে টুইটম্বুর হয়ে যায়। তখন আমার বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, একটি নৌকা ভাড়া করে তাতে মাইক বাজিয়ে রান্নাবান্নার ব্যবস্থাসহ আমরা আমাদের বাড়ি থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে মধুমুড়া যাব।বন্যার কারণে তখন স্কুল-কলেজসহ সকল প্রকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। যে কথা সেই কাজ ।

একদিন সকালে আমার বাড়ির পশ্চিম পাশে নৌকাএলো। আব্বা আম্মার কাছে অনুমতি চাইলাম ।কিন্তু অনেক দূরের রাস্তা হওয়ায় এবং ওই এলাকায় আমাদের পরিচিত জীবন ও আত্মীয়স্বজনের বাড়ি না থাকায় মা অনুমতি দিতে চাইলেন না। পরবর্তীতে আমার বন্ধুবান্ধবরা অনেকক্ষণ বোঝানোর মায়ের সম্মতি পেলাম।পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে চাল ডাল হাঁসের মাংস খাওয়ার জন্য জীবন্ত হাস লাকড়ির চুলা শহর সবকিছু নিয়ে নৌকায় উঠলাম।আমার উপরে দায়িত্বপূর্ণ হাঁস জবাই করা কারণ আমরা মোল্লাবাড়ির ছেলে তাই সবাই আমাকে দায়িত্ব দিল কিন্তু আমি হাঁস জবাই করার সময় হাসির মাথা দেহ থেকে পৃথক হয়ে যায়। তাই কেউ বলল ,এ হাঁস খাওয়া যাবেনা।

জবাইয়ের সময় গলা অথবা মাথা পৃথক হয়ে গেলে সেটা মাকরুহ হয়ে যায়।তাপান বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে এ নিয়ে হট্টগোল বেঁধে যায় ।কেউ কেউ আমার পক্ষ নেয় -যে খাওয়া যাবে। কেউ কেউ বলেন আমরা খাব না। পরবর্তীতে অন্য কোন উপায় না দেখে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়। আমরা নৌকা দিয়ে যাওয়ার সময় চারদিকে সামনে পিছনে তাকালাম। তখন শুধু পানি আর পানি দেখতে পাই। কতগুলো শাপলা দেখে আমরা মাঝিকে বলি সেখানে নিয়ে যেতে। আমার বন্ধু একটি সাদা রঙ্গের শাপলা পানি থেকে উঠিয়ে নৌকায় আনে। আরেকজন -কত্ত বড় শাপলা এই কথা বলে শাপলার ফুলটি টেনে ছিঁড়ে নিয়ে যায়।

আমি সেটি মেপে দেখি পুরো আট হাত। মাইক দিয়ে বলে দেওয়া হল -এখানে অনেক পানি যারা সাঁতার জানেনা তারা যেন নড়াচড়া না করে ।নৌকা থেকে পড়ে গেলে আমরা তাকে উঠাবো না ।এ কথা বলাতে সবাই নৌকার মাঝখানে এসে জড়োসড়ো হয়ে বসলো । এসময় একটি ছেলের পা কেরোসিনের বোতলের সাথে ধাক্কা লেগে সবটুকু পরে যায়। তখন সবাই হায় হায় ছেলেটা করল কি বলতে বলতে তাকে দোষারোপ করতে থাকে। কারণ কেরোসিন দিয়ে স্টুবে রান্না করা হচ্ছিল। রান্না এখনো শেষ হয়নি অথচ সবটুকু কেরোসিন পড়ে গেল। সবার পেট চোঁ চোঁ করছে অথচ খাবার ভালোভাবে সিদ্ধ না হওয়া আমরা কেউ খেতে পারছিলাম না।তখন বন্যার পানি এলাকাবাসীর বাড়িতে উঠে গেছে। কেউ কেউ বাঁশ দিয়ে মাচা বানিয়ে তার উপর বাস করছিলেন। সেখানে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা হচ্ছিল।

যুবক ছেলেরা সবাই বাড়ি থেকে চলে গেলও মুরুব্বীরা বাড়ি পাহারা দিচ্ছিলেন।শুনেছি হঠাৎ করে পানি চলে আসে অনেকে তাদের গরু- ছাগল গুলো সঠিকভাবে অন্য কোথাও ব্যবস্থা করতে পারেননি। গরু ছাগলের দড়ি কেটে দিয়ে বলেছেন” যাও যেখানে যেতে পারো বেঁচে থাকো ।আমরা তোমাদের বাঁচাতে পারলাম না । উত্তর দিকে খেয়াল করে দেখলাম একটি কবরস্থান। ডূবো -ডুবো অবস্থা। সেখানে কতগুলো কাক একটি লাশ খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।এই অবস্থা দেখে আমরা আমাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। নৌকা চলতে চলতে একটি বড় বিলে আসলো ।সেখানে বিভিন্ন রঙ্গের শাপলা ফুটে আছে, আমাদের সবাই ক্ষুধার্ত কিন্তু খাদ্য ভালোভাবে সিদ্ধ না হওয়ায় কেউ খেতে পারছিলাম না ।অনেকেই নৌকা থেকে টেনে টেনে শাপলা উঠিয়ে খাচ্ছিল ।রাসেল বলল সব ধরনের শাপলা উঠাতে নেই ,কোন কোন শাপলার মুড়ায় জিন থাকে। শাপলা গাছ ধরে টান দিলে সেখানে নৌকা আটকে যায়। সেখান থেকে আর বের হওয়ার রাস্তা থাকেনা ।তাই আমরা এরপর থেকে আর কেউ শাপলা উঠাবার সাহস পারলাম না। মামুন বলল এই এলাকায় আমার খালার বাড়ি আছে, ওখানে গেলে হয়ত আমাদের রান্না শেষ করে আসতে পারবো। আমরা বললাম এই এলাকায় সবার বাড়িতে পানি উঠেছে ।

এখন আমরা তাদেরকে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না। হঠাৎ একটা বাড়ি থেকে আওয়াজ এলো মামুন মামুন বলে। মামুনের খালাতো ভাই মামুন কে দূর থেকে দেখে চিনে ফেলেছি।তারপর মামুনের সাথে আমরা সবাই তাদের বাড়িতে গেলাম সেখানে রান্না করার ব্যবস্থা হল।তারপর আবার সবাই নৌকায় চলে আসলাম। তরকারি ভালোভাবে সিদ্ধ হলে ভাতের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। চাল অর্ধেক সিদ্ধ হওয়ার পর হওয়ার পর তেল শেষ হয়ে যাওয়ায় চাল গুলো ফুলে যায়। কিন্তু অন্য কোন উপায় না থাকায় আমরা সেগুলো খেয়ে কোনরকমে আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করি।বাড়িতে হলে হয়তো এ ধরনের শক্ত ভাত খেতাম না কিন্তু বন্ধু-বান্ধবের সাথে বনভোজনের আনন্দে এ ধরনের ভাত হাঁসের মাংস দিয়ে খেতে কারো মন্দ লাগছিল না।খাওয়া দাওয়া করার পর সবার মন আগের মত আনন্দে ভরে গেলো। মাইকে আমরা বিভিন্ন ধরনের গান বাজাতে লাগলাম, বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ গানের তালে তালে নাচতে শুরু করলো।হঠাৎ কয়েকজন মুরুব্বি লাঠি নিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে আসলেন। জিজ্ঞেস করলেন তোমাদের বাড়ি কোথায়? তোমরা কোন জায়গা থেকে এসেছ ? আমাদের বাড়ি- ঘরের মধ্যে পানি উঠেছে।

আমরা অনেক কষ্টে আছি ।আর তোমরা এসেছ মজা করতে, নাকি আমাদেরকে টিটকারি করতে। তখন আমরা বুঝতে পারলাম এভাবে জোরে জোরে মাইকে গান বাজানো উচিত হয়নি ।পরবর্তীতে আমরা একটু পর মাইক বন্ধ করে নিরিবিলি আমাদের গ্রামে চলে আসলাম ।এই কাহিনীটি কোন আমাদের মনে দোলা দেয়।