জাতীয় চার নেতাকে হারিয়ে সেদিন কীভাবে ছিল তাদের পরিবার?
১৯৭৫ সালের অন্ধকার আগস্টে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্যকে আড়াল করে যে কালো মেঘ দেখা দেয়, সেই মেঘ গাঢ় হয় নভেম্বরে। ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার অনিশ্চিত প্রবাস জীবনের মতো নভেম্বরে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ ভর করে জাতীয় চার নেতার পরিবারে।
খুনি মোশতাক-সেনাদের প্রলোভনের ফাঁদে পা না দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আমৃত্যু অনুসরণ করেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। ঘোর বিপর্যয়ের সেই সময়ে দেশের ও এই চার নেতার পরিবার হারায় তাদের সবচেয়ে ভরসার মানুষদের। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার মতো জাতীয় চার নেতার সন্তানরাও লড়েছেন, নিজেদের গড়েছেন যোগ্য সন্তান হিসেবে। বাবার উত্তরসূরি হিসেবে তাদের কয়েকজন ইতোমধ্যে রাজনীতির মাঠেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। এজন্য ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের পর তাদের নতুনভাবে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এমনকি থাকার জায়গা পেতেও চরম কষ্টের মুখোমুখি হয়েছেন দেশের সার্বভৌমত্ব এনে দেয়া নেতাদের সন্তানরা।
চার নেতার সন্তানদের এই সংগ্রামের কথাগুলো প্রকাশ করা হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত ‘উত্তরণ’ পোর্টালে। এখানে জেলহত্যা পরবর্তী সময়ে চার নেতার পরিবারের নতুন সংগ্রামের খণ্ড চিত্র তুলে ধরেছেন এম মনসুর আলীর ছেলে বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
তিনি বলেন: ‘রাজনৈতিক জীবনে আমার পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। সারাজীবন দেশের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। তাই তার মৃত্যুর পর আমরা অস্বাভাবিক রকমের অভাব-অনটনে পড়ে যাই। আমাদের ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা ছিল না। সরকারি বাসভবন ছাড়ার পর ধানমন্ডিতে এক আত্মীয়ের বাসায় থাকতাম। পরে কাঁঠালবাগানের সেন্ট্রাল রোডে ভাড়া বাড়িতে উঠি। বড় ভাই লন্ডন থেকে কিছু টাকা পাঠাতেন, তা দিয়েই আমাদের সংসার চলত।’
সিমিন হোসেন রিমি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের মেয়ে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরে তার বয়স ছিল ১৪ বছর। জেল হত্যাকাণ্ডে বাবাকে হারালেন তিনি। সেই সময়ের স্মৃতিচারণায় তুলে ধরেছেন তাজউদ্দিন কন্যা।
তার এসব স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, শেষবার তাজউদ্দিনের সঙ্গে পরিবারের দেখা হয় অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে। সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন, ‘মুজিব ভাইকে স্বপ্নে দেখলাম, বলছেন- তাজউদ্দীন তুমি আমার কাছে চলে এসো।’
এরপরই ঘটে ইতিহাসের জঘন্যতম জেল হত্যা। চার নভেম্বর তাজউদ্দিনের লাশ বাড়ি আনার পর প্রথম কয়েক ঘণ্টা কাদঁতে ভুলে গিয়েছিলেন কিশোরী সিমিন।
বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমেদের ছবির সামনে তাজউদ্দীন কন্যা সিমিন হোসেন রিমিসিমিনের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, নভেম্বরের পর তাজউদ্দিনের বাসায় ভয়ে কেউ আসতেন না। নিচের তলাটি একটি স্কুলের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছিলো। সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। চরম আর্থিক সমস্যায় পড়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর পরিবার।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলে ছত্রভঙ্গ আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর জন্য আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তাজউদ্দিনের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন। সেনাশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনিই প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করেন এবং প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে মিলাদের আয়োজন করেন। ২০১৪ সালে মারা যান জোহরা তাজউদ্দিন।
তাজউদ্দিনের একমাত্র ছেলে তানজীম আহমদ সোহেল তাজ গাজীপুর থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সংসদ সদস্যপদ এবং মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে যান। পরবর্তী সময়ে ওই আসনে তার বড় বোন সিমিন হোসেন রিমি উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দশম জাতীয় সংসদেও রিমি নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম বলেন: জেল হত্যাকাণ্ডের পর আমাদের পরিবারের অবস্থা বেশ নাজুক হয়। আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি বাড়িটির ভাড়া নির্ধারণ করা হয় প্রায় ১ লাখ টাকা। ভাড়ার পরিমাণ এত বেশি নির্ধারণ করা হয়েছিল যে, আমাদের পরিবারের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব ছিল না। ফলে আমার মাকে বাধ্য হয়েই ময়মনসিংহে চলে যেতে হয়েছিল। কারণ আমাদের ঢাকায় কোনো বাড়ি ছিল না। কীভাবে সংসার চলবে এ নিয়ে আমাদের অহরহ ভাবতে হয়েছে। তখন আশরাফ ভাই দেশের বাইরে ছিল। নিরুপায় হয়েই মা দুই বোন এক ভাইকে নিয়ে ময়মনসিংহে অবস্থান নিয়েছিলেন। আমি মাত্র ৪৫০ টাকা বেতন পেতাম। তার প্রায় পুরোটাই মাকে পাঠাতাম।
বাংলাদেশের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি এবং মুক্তিযুদ্ধকালে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের পাঁচ সন্তানের মধ্যে একমাত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা। দায়িত্ব পালন করছেন সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে।
ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর পর দীর্ঘদিন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও দলীয় কার্যক্রমে দৃশ্যমান সক্রিয় ছিলেন না তিনি। ২০০৭ সালে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের সময়ে দলের হাল ধরেন। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক থেকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন পর পর দুই কাউন্সিল অধিবেশনে। এ সময়ে রাজনীতিবিদদের নিয়ে জনমনে নানা নেতিবাচক মনোভাব থাকলেও আওয়ামী লীগের মতো দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ সম্মানের জায়গা তৈরি করতে পেরেছেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রথম সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ৬ সন্তানের মধ্যে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন শুধু খায়রুজ্জামান লিটন। দুই ভাই এবং চার বোনের মধ্যে লিটন চতুর্থ। এই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মও এরই মধ্যে রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন। তিনি হলেন খায়রুজ্জামান লিটনের মেয়ে আনিকা সাদিয়া অর্ণা।
খায়রুজ্জামান লিটন গত এক যুগ ধরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আওয়ামী রাজনীতিতে পা রাখেন ১৯৮১ সালে। তখন রাজশাহী যুবলীগের একটি ওয়ার্ডের সহ-সভাপতি পদে আসীন ছিলেন। ১৯৮৬ সালে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত টানা ২৬ বছর রাজশাহী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন