ঝুঁকির তালিকায় আবারও ষষ্ঠ বাংলাদেশ

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ ষষ্ঠ অবস্থানেই রয়ে গেছে। ১৯ বছর ধরে দুর্যোগের সংখ্যা, মৃত্যু, ক্ষয়ক্ষতির মোট হিসাবের ভিত্তিতে তৈরি ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। তবে শুধু গত বছরের হিসাবে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩।

জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা জার্মান ওয়াচ ১৯৯৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বিশ্বের ২০০টি দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে এবারই প্রথমবারের মতো ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের নাম উঠে এসেছে।

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন চলাকালে ওই সংস্থা জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকাটি প্রকাশ করে থাকে। তারা ২০০৮ সাল থেকে ওই তালিকা প্রকাশ করে আসছে। এ বছরে ৯ নভেম্বর ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। জার্মানির বনে জাতিসংঘের ২৩তম জলবায়ু সম্মেলনে স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারে, সে জন্য জাতিসংঘের অভিযোজন তহবিলকে প্যারিস চুক্তির আওতায় নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে সবুজ জলবায়ু তহবিল (জিসিএফ) থেকে অভিযোজন খাতে অর্থ পেতে সুবিধা হবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ গত শনিবার ওই অভিযোজন তহবিলের বোর্ড সদস্য হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছে।

৬ নভেম্বর বন শহরে শুরু হওয়া জলবায়ু সম্মেলনে এ পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধি অংশ নিচ্ছেন। বাংলাদেশের ২৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সম্মেলনে যোগ দিয়েছে। কাল মঙ্গলবার থেকে সম্মেলনের উচ্চপর্যায়ের আলোচনা পর্বে যোগ দিতে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন বনের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তিনি বুধবার বাংলাদেশের পক্ষে সম্মেলনের উচ্চপর্যায়ের সভায় বক্তব্য দেবেন।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য জিয়াউল হক বন থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এবারের সম্মেলনে যেসব দলে ভাগ হয়ে আলোচনা চলছে, তার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে প্যারিস চুক্তি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার পরিকল্পনা বা প্যারিস রুলবুক চূড়ান্ত করা। বাংলাদেশ সবুজ জলবায়ু তহবিল দ্রুত ও সহজে ছাড় করাসহ বিভিন্ন দাবি তুলেছে।

তিন বছর ধরেই বাংলাদেশ ষষ্ঠ
জার্মান ওয়াচের ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১০ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশ ছিল। ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা এগিয়েছে। সর্বশেষ তিন বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ওই তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছে।

তবে ওই প্রতিবেদনে শুধু ২০১৬ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১৩তম অবস্থানে রয়েছে। ওই বছরের তালিকায় শীর্ষ তিনটি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে হন্ডুরাস, হাইতি ও মিয়ানমারের নাম রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ষষ্ঠ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ।

প্রথমবারের মতো এবারের তালিকায় থাকা যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে ক্যারোলিনা ও আগস্টে লুইজিয়ানায় বড় বন্যা হয়। জুনে বেশ কয়েকটি বনভূমিতে আগুন লাগে। টেনেসি, ফ্লোরিডা ও জর্জিয়ায় নানা ধরনের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ছিল। সব মিলিয়ে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে প্যারিস চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ১৯৯৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে মোট ৮৫৯ জন মারা গেছেন। ওই সময়ে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি ডলার। আর মোট ১৮৭টি দুর্যোগ বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। এসব দুর্যোগের মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসের মতো দুর্যোগ রয়েছে।

প্রতিবেদনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বলতে বাংলাদেশসহ ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ও দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর নাম আসত। বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী রাষ্ট্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে। ফলে পুরো বিশ্বকে রক্ষা করতে হলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সব দেশকে একত্রে যে কাজ করতে হবে, তা ওই প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়েছে।

তবে দেশের জলবায়ু ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশে দুর্যোগ বেশি আঘাত হেনেছে। বিশেষ করে চলতি বছরের এপ্রিলে হাওরে বন্যা, আগস্টে দেশের উত্তরাঞ্চলে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বন্যা, পাহাড়ধসের মতো বড় দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশ। আর্থিক ক্ষতির দিক থেকেও চলতি বছর বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে হাওরে বোরো ফসল নষ্ট হওয়া, উত্তরাঞ্চলে আমন ফসল তলিয়ে যাওয়ার মতো দুর্যোগের মুখে পড়েছিল বাংলাদেশ।

এসব দুর্যোগের কারণে চলতি বছর বাংলাদেশকে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে। সরকারি হিসাবেই চলতি বছর প্রায় ১৫ লাখ টন ধান নষ্ট হয়েছে, বেসরকারি হিসাবে এই ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ। ঘাটতি মোকাবিলা করতে বাংলাদেশকে বিশ্বের ছয়টি দেশের কাছে চাল আনতে ধরনা দিতে হয়েছে। এমনকি যে মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা তৈরি হয়েছে, তাদের কাছ থেকেও এক লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করতে হয়েছে।

এসব তথ্য উল্লেখ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ বাংলাদেশে দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। এত দিন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকটে পড়তে দেখিনি। এ বছর আমরা একের পর এক বিপদ অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশে টের পাচ্ছি। ফলে আমাদের আগের চেয়ে আরও বেশি করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রস্তুতি ও উদ্যোগ নিতে হবে।’