ট্রাম্প থাকলে সাদ্দামকে কি গদি ছাড়তে হতো?

রবার্ট ফিস্ক : হামলা এড়ানো যেত। তারপরও আজ থেকে ১৫ বছর আগে মার্চ মাসের ঠিক এই সপ্তাহে আমরা ইরাকে হামলা চালিয়েছিলাম। এটা ছিল অপরাধমূলক যুদ্ধ। আসলে এটা ছিল যুদ্ধাপরাধ। এই যুদ্ধের নৃশংসতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার মতো জাতিসংঘের পাস করা কোনো প্রস্তাব ছিল না। এই যুদ্ধ একটি সচ্ছল আরব জাতিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। এই যুদ্ধে আরব ভূমি তার লাখ লাখ সন্তানসন্ততি হারিয়েছে। লাখ লাখ মানে কত? ১০ লাখ? ১৫ লাখ? কে জানে? কার ঠেকা পড়েছে গুনে দেখার? আমরা লাশ গোনার কাজ করি না। আমরা সত্য বলি না। ওই যুদ্ধের সময় আমরা মিথ্যার নতুন রেকর্ড গড়েছিলাম।

এটা নিশ্চিত যে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমাদের এই ট্র্যাজেডি থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারতেন। ইতিমধ্যেই তিনি নিজের নির্ভেজাল অসততা এবং রুচিবিকৃতির যে পরিচয় দিয়েছেন তাতে বোঝা যায়, সাদ্দামের সঙ্গে তাঁর মিলত ভালোই। একমাত্র সাদ্দামই তাঁর গ্যাস হামলা ও পরমাণু উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিয়ে ট্রাম্পকে আকর্ষণ করতে পারতেন।

বাগদাদে আড়াআড়িভাবে ঝুলিয়ে রাখা সাদ্দামের জোড়া তলোয়ার, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সমাবেশকক্ষের দেয়ালে টাঙানো রকেটের ছবি, সামরিক কুচকাওয়াজ—এসব নিশ্চয়ই চরম মতাদর্শে বিশ্বাসী এখনকার হোয়াইট হাউসের নজর কাড়ত।

সাদ্দাম নেই। এখন ট্রাম্পের ‘সাদ্দাম’ হলেন কিম জং–উন। সাদ্দামকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল ‘মানসিক ধাক্কা দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে’। এখন ট্রাম্প উনকে একইভাবে ক্রোধ প্রদর্শন করে হুমকি দিয়েছেন।

বুশ কি সাদ্দামকে ‘একজন পাগল’ মনে করতেন না? একই কায়দায় ট্রাম্প কি উনকে ‘মি. রকেটম্যান’ বলেননি? সাদ্দামের জন্য বুশের দেওয়া উপাধিটি লাগসই ছিল। ট্রাম্পও উনকে যা বলেছেন, সেটাও উনের নামের সঙ্গে মানিয়ে গেছে।

বুশ ও ব্লেয়ার এতটাই নৈতিক, এতটাই ভালো, এতটাই সৎ ছিলেন যে তাঁরা তাঁদের নিজেদের মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে লুকোছাপা করেননি। তাঁরা ‘টাইগ্রিসের হিটলার’-এর সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাননি। ট্রাম্পও সেটাই করতে পারতেন। কিন্তু তিনি উনের সঙ্গে বসতে চেয়েছেন।

আমরা সবাই জানি ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগের ১৫ বছরে কী কী ঘটেছে। অগণিত নিরপরাধ মানুষ মরেছে। গৃহযুদ্ধ এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর লড়াই ও খুনখারাবি হয়েছে। আবু গারাইবের কথা এখনো আমরা ভুলিনি। তারপর এল আইএস। তারা লহুর দরিয়া বইয়ে দিল।

২০০৩ সালে ইরাকে দখলাভিযান চালানো এবং পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ কীভাবে সরাসরি ইসলামপন্থার ভিত রচনা করেছিল, তা আমাদের অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে। কয়েদখানা ও নির্যাতন শিবিরে সেই উগ্রপন্থার ভিতের পরিচর্যা হয়েছে। ইরাকে যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধের পর লুটপাট হয়েছে। এটি ইরাককে দেউলিয়া করে দিয়েছে। দুর্নীতিতে দেশটি ডুবে গেছে। এর মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা কাজে লাগিয়ে আইএস তার শক্তি বাড়িয়ে ফেলল। সাদ্দাম যদি ‘হিটলার’ হয়ে থাকেন, তাহলে মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চোখে আইএস হলো ‘পৃথিবী ধ্বংস করার মহাপ্রলয়’।

ইরাক যুদ্ধ আইএস উত্থানের পথ খুলে দিয়েছিল। সেই আইএস ইরাক থেকে এগোতে এগোতে সিরিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। রাকা থেকে মসুল, মসুল থেকে গৌতার পূর্বাঞ্চলের আফরিন ও অন্যান্য শহর আইএসের দখলে গেল।

ইরাকে শিয়া মুসলমানদের ক্ষমতায় বসা ইরানকে স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্ট করেছে। একইভাবে ইয়েমেনের হুতি–নিয়ন্ত্রিত এলাকাতেও ইরানের উপস্থিতি আছে। সেখানে ইরানি অস্ত্র নিয়ে লড়াই চালানো হুতিদের শেষ করতে আমরা এখন সৌদি আরবকে অস্ত্র দিচ্ছি। সেখানে আরও হাজার দশেক লোক মরেছে।

ইরাক সরকার ও সিরিয়ার জিহাদিরা আমাদের কাছ থেকে যেসব অস্ত্র নিয়েছে, সেই অস্ত্রই শেষ পর্যন্ত আইএসের হাতে গেছে। সিরিয়া সরকার নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার পর দৃশ্যপটে হাজির হলো রাশিয়া।

নাইন–ইলেভেন হামলার পর যে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ শুরু হয়েছিল, সেটির ধারাবাহিকতায় আফগানিস্তান, তারপর ইরাক, তারপর আইএসের বিরুদ্ধে হামলা হলো। এখন কুর্দিদের বিরুদ্ধে

অভিযান চলছে। এখানে এখন যুক্ত হয়েছে মস্কো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আমরা বাগদাদ ধ্বংস করেছি। আমরা মসুল গুঁড়িয়ে দিয়েছি। আলেপ্পো ও গৌতা ধ্বংসে যোগ দিয়েছে রাশিয়া। আমরা নীরব দর্শক
হয়ে দেখছি।

এখন মনে হচ্ছে ট্রাম্প যদি তখন গদিতে থাকতেন, তাহলে হয়তো ইরাক যুদ্ধ হতো না। তিনি ‘উত্তর কোরিয়ার হিটলার’ কিমের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন। এতে মনে হয়, তিনি যদি সাদ্দামের সময় ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে তিনি সোজা বাগদাদে উড়ে যেতেন। ‘টাইগ্রিসের হিটলারের’ সঙ্গে তাঁর আলাপ হতো। যুদ্ধ থেকে বিশ্ব রেহাই পেত।

দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

রবার্ট ফিস্ক দ্য ইনডিপেনডেন্ট–এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি