ডলার সংকটেও থেমে নেই গাড়ি আমদানি

কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। স্থানীয় মুদ্রার তুলনায় বেড়েছে ডলারের দাম। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। দীর্ঘ প্রায় একবছর ধরে ডলার সংকট চলছে। এ কারণে ব্যাংকে এলসি খোলা কমে গেছে। এতে ব্যাহত হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি। সংকটের কারণে গত বছরের শেষ চার মাসে অপরিশোধিত চিনি আগের বছরের চেয়ে ২৮ শতাংশ, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ৪৭ শতাংশ, সয়াবিন ৮৩ শতাংশ, অপরিশোধিত পাম তেল ৯৯ শতাংশ, ছোলা ৪৭ শতাংশ ও খেজুর আমদানির এলসি খোলা ৩০ শতাংশ কমেছে।

দেশের এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসপণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হয়। গাড়ি আমদানি ‘বিলাসপণ্য’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় শতভাগ এলসি মার্জিনের আওতাভুক্ত করা হয়। কিন্তু তাতে গাড়ি আমদানি ঠেকানো যায়নি। এমনকি সরকারের নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত অর্থবছরে (২০২১-২২) আগের অর্থবছরের চেয়ে রেকর্ড সংখ্যক গাড়ি আমদানি হয়েছে। যা গত পাঁচ বছরের গাড়ি আমদানির রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।

তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১৩ হাজার ৯১৩টি গাড়ি আমদানি হয়েছে, যা বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২০-২১ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি হয়েছে ১৩ হাজার ৪৪৮টি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর গাড়ি আমদানি হয়েছে চার হাজার ৮০০টি। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১২ হাজার ৫০১টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। এছাড়া তীব্র ডলার সংকটের এমন পরিস্থিতিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরেও গাড়ি আমদানি অব্যাহত রয়েছে। এই অর্থবছরের নভেম্বর মাসের ২২ তারিখে জাপান থেকে এক জাহাজে মোট ৮৫৬টি গাড়ি দেশে আসে। ওই চালানে আসা ১০০টিরও বেশি গাড়ির বিপরীতে কোনো ঋণপত্র বা এলসি খোলাই হয়নি। এরই মধ্যে এলসি ছাড়া আমদানি করা শতাধিক গাড়ি ৪-৬ শতাংশ হারে জরিমানায় খালাস করে নেয় আমদানিকারকরা।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুধু নভেম্বর মাসেই দেশে ৬৫০টি গাড়ি এলসিবিহীনভাবে আমদানি হয়েছে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এইচএনএস অটোমোবাইলস, মরিয়ম এন্টারপ্রাইজ, জিএম ট্রেডিং, এসএসআরএ এন্টারপ্রাইজ ও নাগোহা করপোরেশন গত ১০ ও ২২ নভেম্বর ভেসেল লোটাস লিডার ও মালয়েশিয়া স্টার জাহাজে করে ৯৩৪টি গাড়ি আমদানি করে। আমদানি হওয়া গাড়িগুলোর মধ্যে ৫৮৫টি চালানের মাধ্যমে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি নীতি অনুযায়ী করা হয়েছে ২৮৪টি, বাকি ৩০১টি চালানের এলসি নেই। এই ৩০১টি চালানের বিপরীতে গাড়ি এসেছে ৬৫০টি। এখন এলসিবিহীন গাড়ি চালানের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে এলসি ও এলসিবিহীন গাড়িগুলো চট্টগ্রাম কার শেডে রয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এলসিবিহীন আমদানিকৃত গাড়ির বেশির ভাগই আমদানি করেছেন গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এইচএনএস অটোমোবাইলসের স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম। গত ১০ ও ২২ নভেম্বর আমদানি করা ৯৩৪টি গাড়ির মধ্যে তার প্রতিষ্ঠানের নামে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি এসেছে ২৫টি। মরিয়ম এন্টারপ্রাইজ, জিএম ট্রেডিং, এমএসআরএ এন্টারপ্রাইজ ও নাগোহা করপোরেশনের নামে যথাক্রমে ১৯, ১২, ১০ ও ১০টি গাড়ি এসেছে। এই ৭৬টি গাড়ি ছাড়াও বাকি গাড়িগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এসেছে।

আমদানি নীতি আদেশ আমদানি-রপ্তানি আইন ১৯৫০ অনুযায়ী, কোনো পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হলে সঠিকভাবে পণ্যের শনাক্তকরণ কোড (এইচএস) উল্লেখ করে অনুমোদিত বাণিজ্যিক ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্র খোলার মাধ্যমে আমদানি করতে হবে।

আমদানি সাধারণ ম্যানিফেস্টো (আইজিএম) অনুযায়ী, পণ্যের বিবরণ সঠিক থাকলে রপ্তানিকারকের দেশ থেকে পণ্য জাহাজীকরণ করে আমদানিকারকের বন্দরে পণ্য আনলোড করা হয়। সব ধরনের আমদানির ক্ষেত্রে পণ্য, পণ্যের মোড়ক ও কনটেইনারের গায়ে ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু ৬৫০টি গাড়ির ক্ষেত্রে যথাযথ পক্রিয়া পরিপালন করা হয়নি।

বারভিডার সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডন জানান, ডলার সংকটের কারণে ব্যাংক এলসি না খোলায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে রাজস্ব ফাঁকি হয়নি। এমনকি কারো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। এলসি ছাড়া আমদানি করা ১০০টি গাড়ি ৪ থেকে ৬ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে খালাস করা হয়েছে। তবে আমরা এনবিআরকে নামে মাত্র জরিমানা করতে বলেছিলাম।

উল্লেখ্য, নতুন বছরের শেষেও এখনো পরিস্থিতি উন্নতির কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যদিও এর আগে একাধিকবার সরকারের পক্ষ থেকে নতুন বছরে নগদ ডলার সংকট মিটে যাবে বলে আভাস দেয়া হয়েছিল। উল্টো পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে বলে আশংকা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে বর্তমানে ঋণপত্র (এলসি) খোলা নিয়ে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা আগামী দু-এক মাসের মধ্যে স্বাভাবিক হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।