ঢাকার অপরাধ : গরিব বেশে সক্রিয় নারী অপরাধী
ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর ধানমণ্ডির একটি বাসায়। ৩০-৩৫ বছর বয়সের এক নারী সেখানে গিয়ে গৃহকর্ত্রীর কাছে তাকে কাজের বুয়া (গৃহকর্মী) হিসেবে রাখার আকুতি জানায়। বোরকা পরা নারী নিজের নাম রোকসানা বলে জানায়। দাবি করে, খুব গরিব সে। তার একটি কাজ খুবই দরকার। তার কথা শুনে গৃহকর্ত্রীর মায়া হয়। বাসায় কাজের মানুষও প্রয়োজন। গৃহকর্তা বাসায় ছিলেন না। গৃহকর্ত্রী একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজে নিয়োগ করেন রোকসানাকে। রোকসানা তাকে সকালের নাশতা বানিয়ে দেয়। এরপর দেয় চা। সেই চা পান করেই অচেতন হয়ে পড়েন গৃহকর্ত্রী। আর এই সুযোগে বাসার আলমিরা থেকে স্বর্ণালংকারসহ প্রায় ১৫ লাখ টাকার মালপত্র নিয়ে কেটে পড়ে রোকসানা। এরপর হদিস নেই। গত বছরের ১১ নভেম্বর ঘটনাটি ঘটে। শাহে আলম নামে গৃহকর্তা পরে ধানমণ্ডি থানায় মামলা করেছেন। বাড়ির সিসি ক্যামেরায় রোকসানার অস্পস্ট ছবি মিলেছে। পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে এই নারীকে। তদন্তকারীরা তথ্য পেয়েছেন, দুই মাসের ব্যবধানে ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুরে একই রকম দেখতে এক নারী একইভাবে তিনটি ঘটনা ঘটিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, কথিত রোকসানাই গরিব বুয়া সেজে প্রতারণা করে চলেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অসহায় গৃহকর্মীর পরিচয়ে বাসায় ঢুকে সবাইকে অচেতন করে মালপত্র লুট করার আরো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই বুয়া বেশে অজ্ঞান পার্টির অপতৎপরতার তথ্য পাওয়া যায়। তবে এখন এ অপরাধীরা অভিজাত এলাকাকে বেছে নিচ্ছে। অসহায় সেজে বাসায় ঢুকে বেশি দিন কাজ না করে দ্রুত অপকর্ম করছে। কয়েকটি চক্র ধরার পর পুলিশ ধারণা করছে, এমন অন্তত ২০টি পেশাদার গ্রুপ আছে রাজধানীতে। এসব গ্রুপে বাইরে থেকে সহায়তা করা, কাজ পেতে সাহায্য করা এবং স্বর্নালংকার বিক্রির সদস্যও আছে। এদিকে হাসপাতাল, মার্কেট ও গণপরিবহনে টাকা, মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন, ভ্যানেটি ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে একদল নারী পকেটমার। কয়েক বছর নারী পকেটমারের দৌরাত্ম্য কমলেও এখন ফের বেড়েছে। এরাও দরিদ্র বেশে ঘুরে বেড়ায়। কখনো রোগী, কখনো ক্রেতা বা কখনো যাত্রীর বেশ ধারণ করে। অনেক নারী পকেটমার চক্রের সঙ্গে দৈনিক চুক্তিতে ভাড়ায় কাজ করে। এদের বলা হয় কামলা। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তথ্যমতে, ঢাকায় কমপক্ষে ৩০টি পেশাদার নারী পকেটমার আছে। এরা শাহবাগ, নিউ মার্কেট, গুলশান ১, মিরপুর ১০ ও ১, ঢাকা মেডিক্যাল, শেরেবাংলানগর, পুরান ঢাকার আদালতপাড়া, গুলিস্তান, কমলাপুর ও সায়েদাবাদে বেশি সক্রিয়। ভ্রাম্যমাণ এই নারী অপরাধীরা সাধারণত বোরকা পরেই ঘোরাফেরা করে। এরা দ্রুত নাম-ঠিকানা বদলায়। গ্রেপ্তারের পর জামিনে ছাড়া পেয়ে অপরাধ করলেও তাদের হদিস পাওয়া যায় না।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘ধানমণ্ডির ওই নারী তিনটি বাসায় একইভাবে অচেতন করে চুরি করেছে। এরা এখন বেশি দিন এক বাসায় থাকে না। সম্মানিত নগরবাসীকে আমরা বারবার বলছি পরিচয় নিশ্চিত হয়ে, অর্থাৎ ভোটার আইডি রেখে কাজে নেওয়ার জন্য। যারা অপরাধ করে তারা পরে দেবে বলেছিল। অর্থাৎ এখানেই সচেতন হতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নারীদের সহজেই আটক বা চ্যালেঞ্জ করা যায় না। কোথাও সন্দেহ হলে বা ঘটনা ঘটলে দ্রুত পুলিশকে জানাতে হবে। নারী পুলিশ সদস্যরা এ ক্ষেত্রে সহায়তা করবেন।’
গত ১ মার্চ দুপুরে ফার্মগেট থেকে গুলিস্তানের উদ্দেশে খাজাবাবা পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন মোবাইল এক্সেসরিজ ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন। তাঁর পাশে দু-তিনজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল। তারা কারওয়ান বাজার এসে নেমে যায়। সোনারগাঁ সিগন্যাল পার হওয়ার পর নাসির পকেটে হাত দিয়ে দেখেন মানিব্যাগ নেই। নাসির উদ্দিন বলেন, মানিব্যাগে সাড়ে ১০ হাজার টাকা ছিল।
বেসরকরি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী রেজানুর রহমান ও শিক্ষার্থী রুবেল হোসেনসহ কয়েকজন বাসযাত্রী বলেন, গাবতলী থেকে ছেড়ে আসা ৮ নম্বর পরিবহন, সাভার থেকে আসা ঠিকানা পরিবহন, মিরপুর-সদরঘাট রুটের বিহঙ্গ পরিবহন, ইউনাইটেড পরিবহন, বনানী থেকে কমলাপুরগামী ৬ নম্বর পরিবহন, কেরানীগঞ্জ থেকে মিরপুরগামী দিশারী ও এভারেস্ট পরিবহনে পকেটমারের ঘটনা শুনেছেন তাঁরা। কয়েকটি ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, রাজধানীতে পুরুষের চেয়ে নারী পকেটমারচক্র বেশি সক্রিয়। এরা একেক স্থানে একেক ধরনের কৌশল অবলম্বন করে। হাসপাতালে যায় রোগী সেজে, বাসে ওঠে যাত্রীবেশে, আর মার্কেটে যায় ক্রেতা সেজে। সুযোগ পেলেই এরা পুরুষের মানিব্যাগ, মোবাইল, মহিলাদের ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে টাকা-পয়সা মোবাইল সেট নিয়ে সটকে পড়ে। নারী হওয়ায় এরা ধরা পড়ে কম।
ডিবি পুলিশের সূত্র জানায়, রাজধানীতে নারী পকেটমারের চক্রে পুরুষ সদস্যও আছে। দুই-তিনজন একসঙ্গে কাজ করে। আর সহযোগী বা সুরক্ষা দেওয়ার কাজ করে আরো তিন-চারজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও ঢাকা মেডিক্যাল ঘিরে রোগী অপকর্ম করছে ২০-২৫ জন। একটি দলের হোতা রুমাকে ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার করা হলে পরে সে জামিনে ছাড়া পেয়েছে। নিউ মার্কেটকেন্দ্রিক সক্রিয় অন্তত ১০টি গ্রুপ। মহাখালী থেকে প্রেমা ও শামসুন্নাহার নামে দুই দলনেতাকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পরে তাদের হদিস মেলেনি।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার শেখ নাজমুল আলম জানান, গত বছরের ৫ মার্চ গুলশান ২ নম্বরের ৩৬ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে বাসার লোকজনকে অচেতন করে ৬০ ভরি সোনা নিয়ে যায় এক নারী। গুলশান ধানার একটি মামলা তদন্ত করে ডিবি চক্রটিকে শনাক্ত করে। দলের প্রধান পারভিন আক্তার শাহিনুর ওরফে আলপিনা খাতুনকে (২৮) গ্রেপ্তার করা হয়। তার নেত্রকোনার বাড়ির মাটি খুরে পাওয়া যায় ১৮ ভরি সোনা। নাজমুল ইসলাম বলেন, ওই নারী অভিজাত এলাকায় অপকর্ম করত। বারিধারার একটি বাসা থেকেও ২৭ ভরি সোনা ও হীরার আংটি নিয়ে যায় সে। তাদের সঙ্গে সোনার দোকানি, বাড়ির তথ্যদাতাও আছে। এমন আরো চক্র আছে বলেও তথ্য মিলেছে।
ডিবির সূত্র জানায়, বেশির ভাগ প্রতারক বুয়া ও পকেটমারের বাসা টঙ্গী, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও সাভার এলাকায়। এরা এসে কাজ শেষে আবার বাড়ি ফিরে যায়। আর ঢাকায় যারা বসবাস করে, তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছাড়া বাকিদের প্রায় সবাই বস্তিতে বসবাস করে। এলাকায় তারা নিজেদের গার্মেন্টকর্মী পরিচয় দেয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন