ঢাকার মুগদায় মাদকের ‘পৃষ্ঠপোষক’ সাত পুলিশ কর্মকর্তা

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অভিযানের মধ্যেই জানা গেল, খোদ রাজধানীর মুগদা থানারই সাত পুলিশ কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছেন। টাকা নিয়ে মাদক বেচাকেনার সুযোগ করে দিতেন তাঁরা। মাদক ব্যবসায়ীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করা সাত কর্মকর্তার নাম ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

ওই সাত পুলিশ কর্মকর্তাকে মুগদা থানা থেকে প্রত্যাহার (ক্লোজড) করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এনামুল হক। পুলিশের ওই সদস্যদের গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে ডিএমপি সূত্র জানায়।

এদিকে রোববার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) নরসিংদীর বেলাব থেকে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে আরেক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি বেলাব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোরশেদ হোসেন।

এর আগে গত সপ্তাহে রাজবাড়ী থেকে হাইওয়ে রেঞ্জের এসআই বেলাল হোসেন, নারায়ণগঞ্জ সদর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) সোহরাওয়ার্দী হোসেন, নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার কনস্টেবল আসাদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া গত ২৬ এপ্রিল ইয়াবাসহ খিলগাঁও থানার এএসআই মজনু হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া এই পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী ও মজনু ছাড়া বাকি তিনজন অপরাধ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম গতকাল বিকেলে বলেন, মাদক বেচাকেনায় জড়িত ব্যক্তিদের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এখানে কে পুলিশ, কে পাবলিক তা বিবেচ্য বিষয় নয়।

মাদকের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর গত ছয় দিনে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৯ জন নিহত হয়েছেন। তাঁরা সবাই মাদক ব্যবসায়ী বা মাদক মামলার আসামি বলে র‍্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারা জানান।

মুগদায় মাদকের পৃষ্ঠপোষক সাত পুলিশ সদস্য
রাজধানীর মুগদা থানা এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা করার ঘটনায় সাতজনকে প্রত্যাহার (ক্লোজড) করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। তাঁরা হলেন মুগদা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নুরুল আমিন, এএসআই আবদুল ওয়াদুদ, এএসআই মো. সেলিম হোসেন, এএসআই জয়নুল আবেদীন, এএসআই খালেদুর রহমান ও এএসআই মো. আক্তারুজ্জামান। এ ঘটনায় ডিএমপি সদর দপ্তরের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) শেখ নাজমুল আলমকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি হয়েছে।

মাদক-বাণিজ্যে সাত পুলিশ সদস্যের জড়িত থাকার বিষয়ে মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টির তদন্ত হচ্ছে। সত্যতা পাওয়া গেলে মামলা করা হবে।

ডিএমপির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গত ৫ মার্চ রাত সাড়ে নয়টার দিকে মুগদার দক্ষিণ মান্ডার বন্ধু বেকারি গলিতে অভিযান চালান ওই সাত পুলিশ কর্মকর্তা। ৪০টি ইয়াবা বড়িসহ স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী স্বপন মিয়াকে আটক করেন তাঁরা। এরপর স্বপনকে নিয়ে তাঁরা স্থানীয় গ্রিন মডেল টাউনের বালুর মাঠে যান। স্বপনকে মামলায় জড়ানো হবে জানিয়ে তাঁর সঙ্গে থাকা ১২-১৩ হাজার টাকা কেড়ে নেন তাঁরা। এমনকি ওই রাতেই স্বপনের স্ত্রীর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ নেন ওই সাত কর্মকর্তা। সমঝোতা হওয়ায় স্বপনকে মাদক মামলার আসামি না করে ছেড়ে দেওয়া হয়।

পুলিশের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মুগদা থানার এএসআই ওয়াদুদ, নুরুল আমিন ও আক্তারুজ্জামান মানিকনগরের মিয়াজান গলিতে মাদক ব্যবসায়ী লিমা আক্তার ও তাঁর স্বামী দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলা এবং সালমা আক্তারের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে এক হাজার টাকা নিতেন। এ ছাড়া আরেক মাদক ব্যবসায়ী নিজুর কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে নিতেন তাঁরা।

এ বিষয়ে মুগদা থানার পরিদর্শক (অভিযান) সৈয়দ ইফতেখার হোসেন বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করা হলেও কিছুদিনের মধ্যে তাঁরা জামিনে বেরিয়ে এসে একই অপরাধে জড়ান। গত বছরের ডিসেম্বরে স্বপনকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হলেও কিছুদিনের মধ্যে তিনি জামিনে বেরিয়ে যান। গত এপ্রিলে মুগদা থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ২৪টি মামলা হয়। এসব ঘটনায় ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মুগদা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পুলিশের সহযোগিতায় সেখানে মাদক ব্যবসা চলছে। গত বৃহস্পতিবার মুগদার মান্ডা এলাকায় স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী বলেন, এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন মুসা, টুইল্যা রুবেল ও সাজু। তাঁদের সঙ্গে মুগদা থানার ওই সাত পুলিশ কর্মকর্তার সখ্য রয়েছে। এর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজনসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জড়িত। তবে নিরাপত্তার কারণে ওই নেতাদের কারও নাম বলতে চাননি তাঁরা।

মাদকের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়ে মুগদা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম আল মামুন গতকাল রাতে মুঠোফোনে বলেন, মুগদা, মানিকনগর ও মান্ডার অলিগলিতে মাদক ব্যবসা হয়। তবে আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত কি না, তা তাঁর জানা নেই। পুলিশ ভালো বলতে পারবে। দলের কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুগদার দক্ষিণ মান্ডা এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় মান্ডার অলিগলি, ঝিলপাড় ও নামা এলাকায় ইয়াবা বেচাকেনার আসর বসে। বহিরাগত যুবকেরাই এর মূল ক্রেতা। মাঝেমধ্যে সেখানে পুলিশ লোকদেখানো অভিযান পরিচালনা করে। পুলিশি অভিযানের খবর আগেই মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে যায়। পুলিশের কাছে স্থানীয় সব মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা আছে। তারা ইচ্ছা করলেই এলাকা মাদকমুক্ত করতে পারে। তিনি বলেন, সন্তান মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা এলাকার সব অভিভাবকের মধ্যে রয়েছে।

এ বিষয়ে মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনামুল হক বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়ে মুগদায় মাদক ব্যবসা হয় ঠিকই, তবে মাদকসহ ধরা পড়লে কাউকেই ছাড় দেওয়া হয় না। এলাকায় প্রতিদিন মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। থানার সাত কর্মকর্তার মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় পুলিশ বাহিনী নেবে না। সূত্র : প্রথম আলো