ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে শুধু লাশ আর লাশ

রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারে ভবনে ভয়াল আগুনে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। উদ্ধারকারী কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ৭০ জনের লাশ উদ্ধারের তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে আভাস পাওয়া গেছে। মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিচ্ছেন আরও অনেকে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে গিয়ে দেখা যায়, শুধু লাশ আর লাশ। সারি বেঁধে লাশগুলো রাখা হয়েছে বারান্দায়। দেখে মনে হচ্ছে লাশ রাখার ঠাঁই হচ্ছে না হাসপাতালে।

বেশিরভাগ নিহতের শরীর পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। চেহারা বোঝা মুশকিল। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া লাশ শনাক্ত করা মুশকিল হয়ে পড়বে।

চকবাজারের দায়িত্বরত ফায়ার সার্ভিসের তদারকি দলের প্রধান মেজর শাকিল নওয়াজের বরাত দিয়ে ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের ডিউটি অফিসার মিজানুর রহমান বৃহস্পতিবার দুপুরে জানান, এখন পর্যন্ত ৭০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আহত ৪১ জনকে উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই গুরুতর।

উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে। কারণ যাদের দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই গুরুতর। তাদের অনেকের শরীরের অনেকটাই পুড়ে গেছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের ডেপুটি অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর তারেক হাসান ভূঁইয়া এক ব্রিফিংয়ে জানান, তিনি নিজেই ঘটনাস্থল থেকে ৬৭ জনের লাশ উদ্ধার করেছেন। আরও কয়েকজনের লাশ ঢামেক মর্গে আনা হয়েছে।

অগ্নিকাণ্ডস্থল থেকে ৬৭জনের লাশ ঢাকা মেডিকেল মর্গে রাখার কথা জানিয়েছে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ।ময়নাতদন্তের পর শনাক্তকরণের ভিত্তিতে লাশগুলো তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢামেক ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধদের মধ্যে ৯ জনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। এদের প্রাণও যায় যায় অবস্থা।

এই ৯ জনের মধ্যে আটজনকে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে এবং একজনকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে।

এই ৯ জনের সবাই গুরুতর দগ্ধ। তাদের সবার শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢামেক বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কারী সামন্ত লাল সেন।

আইসিইউতে ভর্তি থাকা সোহাগের শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে। আর পোস্ট অপারেটিভে ভর্তি আটজনের মধ্যে রেজাউল করিমের শরীরের ৫৭ শতাংশ পুড়ে গেছে। জাকির হোসেনের ৩৮ শতাংশ, মুজাফফর আহমদের ৩০ শতাংশ, আনোয়ার হোসেনের ২৮ শতাংশ, হেলাল উদ্দিনের ১৬ শতাংশ, সেলিমের ১৪ শতাংশ, মাহমুদের ১৩ শতাংশ এবং সালাউদ্দিনের ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে।

বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কারী সামন্ত লাল সেন জানান, ভর্তি ৯ জনের মধ্যে কারও অবস্থাই ভালো নয়। প্রায় সবারই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে।

সব মিলিয়ে নিহতদের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

সরিজমিন ঢামেক মর্গে গিয়ে দেখা গেছে, উদ্ধার হওয়া লাশগুলোর বেশিরভাগই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। কাউকে দেখে শনাক্ত করা কঠিন। তবু এরই মাঝে লাশের ভেতর নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন স্বজনরা। যদি কাউকে কোনোভাবে শনাক্ত করা যায়।

ঢামেক মর্গে মা খুঁজছেন সন্তানের লাশ। স্ত্রী খুঁজছেন স্বামীকে, সন্তান বাবা-মাকে। স্বজনের লাশের খোঁজে কেউ চিৎকারে ফেটে পড়ছেন। কেউ হয়ে যাচ্ছেন শোকে পাথর। কেউ আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছেন।

সব মিলিয়ে লাশ ঘিরে স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। গোটা এলাকায় চলছে এক শোকের মাতম।

লাশ শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া ও হস্তান্তরের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উদ্ধার করা লাশগুলো ফায়ার সার্ভিসের ব্যাগে নম্বর দিয়ে দেয়া আছে। কেউ স্বজনের লাশ শনাক্ত করলে, ব্যাগের নম্বর জানিয়ে পুলিশের কাছে নাম-ঠিকানা লিখিয়ে যেতে হবে। মেডিকেলের প্রয়োজনীয় তদন্ত শেষে স্বজনদের লাশ বুঝিয়ে দেয়া হবে।

প্রসঙ্গত রাজধানীর চকবাজার এলাকার নন্দকুমার দত্ত সড়কের চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পেছনের একটি ভবনে বুধবার রাত ১০টা ১০ মিনিটে আগুন লাগে। রাত সাড়ে ৩টার দিকে আগুনের ভয়াবহতা কিছুটা কমলেও আবারও বেড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট একযোগে কাজ করে বুধবার দিবাগত রাত সোয়া ৩টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। উদ্ধার অভিযান চলে বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। এ ঘটনায় অন্তত ৭০ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন ৪১ জন।