দুর্বল মুদ্রা নিয়ে সবল থাকতে পারবেন তো এরদোয়ান?
রওশন জামিল চৌধুরী : সপ্তাহের শুরুতে সাতসকালে জার্মানির ভিসবাদেনের অধিবাসীদের চোখ কপালে। শহরের প্লাৎস ডার ডুশেনে (জার্মান ইউনিটি স্কয়ার) ১৩ ফুট উঁচু রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের এক মূর্তি, জনগণকে শাসাচ্ছে যেন। অনেকটা বাগদাদের সিটি স্কয়ারে সাদ্দাম হোসেনের মূর্তির মতো, ২০০৩ সালে ইরাক অভিযানের সময়ে মার্কিন সেনারা যেটি ভেঙে ফেলে।
খোঁজ, খোঁজ, কী ব্যাপার! মুহূর্তে এরদোয়ানের শরীর ভরে ওঠে অশ্রাব্য গ্রাফিতিতে। মূর্তির নিরাপত্তা বিপন্ন দেখে দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির এই শহরের কর্তৃপক্ষ দমকল বাহিনী ডাকল, সরিয়ে নিল পাথরের এরদোয়ানকে। ইতিমধ্যে জানা গেছে, ওটা ছিল একটা আর্ট ইনস্টলেশন, ভিসবাদেনে সমকালীন শিল্পকলার দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীর অংশ, কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই ওখানে রাখা হয়েছিল। এ বছরের শিল্পকলা উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য: ‘খারাপ খবর’।
এক অর্থে, তুরস্কের জন্য এরদোয়ান হয়ত আসলেই ‘খারাপ খবর’। একসময় মানুষ মনে করত, তাঁর দেশ—ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক তুরস্ক—শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) আসন পাবে, পশ্চিমের ধনী উদারনৈতিক দেশগুলোর কাতারে তার জায়গা হবে। এই তো কিছুদিন আগেও বিনিয়োগকারীদের চোখের মণি ছিল তুরস্ক। দেশটাকে তারা সম্ভাবনাময় উদীয়মান বাজার দেখেছিল।Eprothomalo
কিন্তু সেই দিন বিগত। এরদোয়ানের দেশ এখন কঠিন অর্থনৈতিক সংকটে। দেশটির মুদ্রা লিরার মান পড়তির দিকে। বলতে কি, ২০০২ সালে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। এ বছর লিরার মান প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে। এর ফলে তুরস্কের বিদেশি মুদ্রার ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিতে পারে। যার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়া বিচিত্র নয়।
সমস্যাটা একমাত্রিক নয়। শীতল যুদ্ধোত্তর সময়ে উদীয়মান বাজারগুলো হামেশা এ ধরনের সমস্যায় পড়ে। এই দেশগুলোর বাজার সদা অশান্ত। ঝুঁকি যেমন বিরাট, পুরস্কারও তেমনি আকাশছোঁয়া। আবার লিরার পতনের পেছনে ভূরাজনৈতিক বিষয়-আশয়ও কাজ করছে। শীতল যুদ্ধ অবসানের পর বিশ্বব্যাপী যে মৈত্রী কাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা এখন নতুন করে লেখার চেষ্টা চলছে। এর কেন্দ্রে আছে তুরস্ক।
প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তাঁর দেশের সমস্যার পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত দেখছেন। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপটে তুরস্ক একটা ক্রান্তির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এরদোয়ান লিরাকে এর কেন্দ্রে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি সম্ভবত সত্যিই বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার সমর্থকেরা এই চক্রান্তের পেছনে রয়েছে। তিনি তাদের উদ্দেশে আঙুল তুলেছেন, বলছেন, দেশগুলো তুরস্কের বিরুদ্ধ ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’ শুরু করেছে।
বয়ানটা বদলানোর জন্য ট্রাম্প প্রশাসন কিছুই করেনি। আগস্টের গোড়ায় মার্কিন ধর্মযাজক অ্যান্ড্রু ব্রনসনকে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে তুরস্ক আটক করলে ওয়াশিংটন ও আঙ্কারার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবরোধ আরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে তুরস্কের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম রপ্তানির ওপর শুল্ক দ্বিগুণ করেন। একই সময়ে ট্রাম্প, ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন তুরস্ককে সতর্ক করে দেন, ব্রনসনকে এক্ষুনি না ছাড়লে তুরস্কের কপালে আরও খারাবি আছে।
এরদোয়ান যা-ই বলুন, লিরা আগে থেকেই মান হারাচ্ছিল। তুরস্কের ঝুঁকিতে থাকা অর্থনীতিকে যুক্তরাষ্ট্র আরও চাপে ফেলেছে সত্যি, কিন্তু সেটা ‘চক্রান্তের’ পর্যায়ে পড়ে না, যেমনটা এরদোয়ান দাবি করছেন।
অবশ্যি এ ধরনের যুক্তিতে আত্মতুষ্টি মেলে। সমস্যার মূলে তাঁর দেশের বিরুদ্ধে বিদেশি রাষ্ট্রের চক্রান্ত, এটা বললে লিরার দাম পড়ে যাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বের দিকে অভিযোগের তির ছোড়া সহজ হয়। বাজারের মতিগতি, এরদোয়ানের অর্থ ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার বদলে সমস্যাটা বিদেশি এজেন্ডার বিরুদ্ধে জাতীয় অর্থনীতির প্রতিরোধের বয়ান হয়ে ওঠে, যা হয়তো ভবিষ্যতে বিষয়টাকে আসলেই আন্তর্জাতিক করে তুলবে।
আঙ্কারা প্রথমে তাৎক্ষণিক সাহায্যের জন্য তার হাতে গোনা মিত্রদের দরজায় ধরনা দিয়েছিল। এতে এগিয়ে আসে একমাত্র কাতার। তুরস্কের অর্থনীতি চাঙা করার জন্য ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার লগ্নির প্রতিশ্রুতি দেয়। এটা দেশটিকে তুরস্কের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং আঙ্কারা ও দোহার মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করে। স্বাভাবিকভাবেই কাতারের পড়শি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে পছন্দ হয়নি ব্যাপারটা। এটাকে তারা উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিল ও কাতারের উপসাগরীয় আরব মিত্রদের সঙ্গে দোহার বিশ্বাসঘাতকতা মনে করে এবং কাতারকে মুসলিম ব্রাদারহুড ও ইরানের পক্ষ নেওয়ার জন্য দায়ী করে। গত মার্চে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তুরস্ক, ইরান ও ইসলামি জঙ্গিবাদীদের শয়তানের অক্ষ বলে অভিহিত করেন।
লিরা-সংকট তুরস্ককে ইউরোপীয় দেশগুলোর আরও কাছে ঠেলে দিতে পারে। এসব দেশ ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের অর্থনৈতিক হাত-মোচড়ানো ব্যবস্থায় চাপে রয়েছে। তুরস্ক ও ইউরোপ উভয়ই বোঝে তাদের একে অপরকে দরকার। এরদোয়ানের পক্ষে একসঙ্গে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে ঠেলে দেওয়া সম্ভব নয়। ইউরোপও চাইবে না তুরস্কের অর্থনীতি ধসে পড়ুক। সে ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের ধাক্কা তাদের গায়েও লাগতে পারে। তা ছাড়া ২০১৬ সালে ইইউ আর তুরস্কের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল—ইউরোপের সীমান্তে জড়ো হওয়া অবৈধ উদ্বাস্তুদের তুরস্ক ফিরিয়ে নেবে—অর্থনৈতিকভাবে বিপদগ্রস্ত তুরস্কের পক্ষে সেটা রক্ষা করা সম্ভব হবে না, এমন ভয়ও রয়েছে।
এই সংকট রাশিয়ার সামনে সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে আঙ্কারা ও ওয়াশিংটনের মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে যার প্রক্রিয়ায় ন্যাটো দুর্বল হচ্ছে। আমেরিকার চাপ সামাল দেওয়ার জন্য মস্কো কোনো রকম আর্থিক সহায়তা দিতে পারে কি না, সে চেষ্টা করে দেখবে তুরস্ক। রাশিয়ার সেই সামর্থ্য বা সদিচ্ছা আছে কি না, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। তবে এরদোয়ানের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের সব ধরনের কৌশল মস্কো করবে, তাতে সন্দেহ নেই। গত সপ্তাহে রাশিয়া সফরে আসা তুরস্কের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদলকে পুতিন পরিষ্কার ভাষাতেই বলেছেন, তুরস্কের সঙ্গে আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক গভীর হচ্ছে। ক্রেমলিনপন্থী মিডিয়া বিষয়টাকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তুরস্ক ও রাশিয়ার গাঁটছড়া হিসেবে দেখাতে চাইতেই পারে।
তুরস্ককে এই সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করতে পারে চীন। তার সেই আর্থিক সক্ষমতা আছে। কিন্তু বিনিময়ে কী চাইবে চীন? এটা খুবই সম্ভব, তুরস্কের শিল্প ও অবকাঠামো খাত থেকে পর্যটন ও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক লগ্নির সুযোগের বিনিময়ে চীন সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে। তুরস্কের অর্থনীতি খুবই নাজুক অবস্থায়, তারপরও দেশটিতে দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা রয়েছে—চীন এমন ভাবতে পারে। তুরস্কের অর্থনীতি বহুমুখী, বিশ্বের জন্য খোলা এবং এর জনশক্তি তরুণ, শিক্ষিত ও গতিশীল। বেইজিং যদি এরদোয়ানকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হতে রাজি করাতে পারে এবং চীনের সঙ্গে তুরস্কের বাণিজ্য বৃদ্ধি করে, তাহলে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে এরদোয়ানের চুক্তি সই সময়ের ব্যাপার।
সবকিছুই নির্ভর করছে লিরা স্থিতিশীল করা যাচ্ছে কি না এবং আঙ্কারা ও ওয়াশিংটন সম্পর্ক কেমন থাকে তার ওপর। এই সম্পর্ক কেবল ব্রনসনের ভাগ্যের ওপর নির্ভর করবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সম্পর্কের ভিত্তিতে বেশ কিছু বিষয় ফাটল ধরিয়েছে। সমঝোতা সেগুলো নিরসনের ওপরেও নির্ভর করবে। ঘটনা যা-ই হোক, এটা পরিষ্কার যে তুরস্কের মুদ্রাসংকট আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপত্র অনুসারে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি উপাদান ও ‘কাঠামোগত সামঞ্জস্যবিধানের’ মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমীকরণের পরিবর্তনশীলতার ওপর নির্ভর করবে, যার প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী।
-রওশন জামিল চৌধুরী : লেখক ও সাংবাদিক।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন