নরসিংদীতে একজন মানবিক ডিসি ফারহানা কাউনাইন ও কিছু কথা

বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিষ্টিকদের জন্যে প্রতিষ্ঠাধীন একটি বিদ্যালয়ের নাম। আবাসিক সুবিধাসহ পূর্ণাঙ্গ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে বানিয়াছল মৌজায় ৫০ শতাংশ জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। ‘যূথবদ্ধ’। নারী-পুরষের যুগপৎ অবদান তুলে ধরতে সার্কিট হাউজের সামনে নির্মিত ভাস্কর্য। শাপলা, সর্বজায়া, চন্দ্রপ্রভা, রাধাচূড়া, স্বর্ণলতা, মেঘনা, তিতাস, ব্রহ্মপুত্র, শীতালক্ষা, আড়িয়াল খাঁ, পাহাড়িয়া- সার্কিট হাউজের বিভিন্ন কক্ষের নাম।

‘ঐক্যতান’; আধুনিকায়নকৃত সম্মেলন কক্ষের নাম। ডাইনিংয়ের নাম ‘জাফরান’। এমন নামকরন আর নান্দনিক কাজের ছোয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়েও। আধুনিকায়নকৃত অফিস ভবন ও কনফারেন্সে রমের নাম, ‘মমতার মানচিত্র’, ‘কীর্তি সুহাস’।

কালেক্টরিয়েটের দোতলায় উঠার সিড়িতে ‘আমাদের স্বপ্ন সোপান’ নামে শোভিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অগ্রযাত্রার নানা ধাপ। তাঁতশিল্পের সূতিকাগার নরসিংদীকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নান্দনিক ও শৈল্পিক উপায়ে উপস্থাপন করছে ব্র্যান্ডিং কর্নার‘তাঁত প্রতিভাস’।

জেলা প্রশাসনের অর্জন সম্বলিত কর্নার ‘ঐশ্বর্য’। মুজিববর্ষে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রবেশপথে স্থাপন করা হয়েছে জাতির পিতার কর্মময় জীবনের প্রতিচিত্র ‘মুক্তির মহানায়ক’। যা প্রতিনিয়ত এ কার্যালয়ে আসা মানুষকে মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনা ও স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অগ্রগণ্য ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেবে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছে“জয় বাংলা চত্বর”। যার মর্মস্থলে অবস্থান করছে জাতির পিতার নবনির্মিত ম্যুরাল “জাগ্রত জাতিসত্তা”। ‘৭১ শেকড়ের মূর্ছনা’- মুক্তিযুদ্ধ কর্নার ও সমৃদ্ধ পাঠাগারের নাম।

এছাড়াও ৬ টি উপজেলার ভূমি অফিস প্রাঙ্গণে জাতির পিতার ম্যুরাল “চিরঞ্জীব মুজিব” স্থাপন করা হয়েছে। জেলার ১১৬৮টি বিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার।’ যেখানে স্থান পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গুরত্বপূর্ন ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর দেয়ালচিত্র, ভাস্কর্য এবং বই।
জেলা প্রশাসকের আবাসিক কার্যালয়ে আসা অতিথিদের জন্য অতিথিশালা ‘অপরাজিতা’। সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন। নরসিংদীর প্রথম নারী জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট।

সতেরতম জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ৩ বছর ৩ মাসের কর্মকালে নানা ক্ষেত্রে অর্জন করেন শ্রেষ্ঠত্ব। সময় পরিক্রমায় কর্মগুণে সব শ্রেণির মানুষের আপনজন হয়ে উঠেন ব্যতিক্রমী এই জেলা প্রশাসক।
সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে বদলী হয়েছেন মাঠ প্রশাসনের জনপ্রিয় এই কর্মকর্তা। বিদায় লগ্নে মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হচ্ছে তার কাজের প্রশংসা। জনবান্ধব প্রশাসক হিসেবে তার দায়িত্ব পালনের সুনাম।

নরসিংদী সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ আলী বলেন, প্রথমে ভেবেছিলাম একজন নারী জেলা প্রশাসক ভালো কাজ করতে পারবেন কিনা। এখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে কতোটুকু খাপ খাওয়াতে পারবেন। কিন্তু আমাদের সেই ধারনা পাল্টে দেন তিনি। সবাইকে সাথে নিয়ে শুর করেন তার নরসিংদী যাত্রা। আমরা দেখলাম চলনে-বলনে, কথাবার্তায় এবং আচরনে খুবই ভালো একজন মানুষ। তার চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। একজন সৃজনশীল-সৃষ্টিশীল মানুষ। দেশের মাটি ও মানুষকে আপন ভেবেই কাজ করেছেন তিনি এখানে ৩ বছর।

আমাদের জেলা প্রশাসক কার্যালয়, সার্কিট হাউজকে সুন্দরভাবে সজ্জিত করেছেন। জবস কর্ণার স্থাপন করে সাড়ে ৫’শ লোককে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। এটা আমাদের জন্যে এক প­াস পয়েন্ট।

এছাড়া স্কুল-কলেজগুলো সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্যে মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার স্থাপনের পাশাপাশি অনলাইনে ক্লাসগুলো যাতে হয় সেই চেষ্টা করেছেন। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় তিনি ও তার প্রশাসন বিরাট ভূমিকা পালন করেন। গঠন করেন কুইক সার্ভিস টিম। পথ শিশু থেকে শুর করে ওপরের লেভেলের সবার সাথে ভালো আচরণ করেছেন। কথাবার্তা শুনেছেন। চেষ্টা করেছেন সাধ্য অনুযায়ী কাজ করে দেয়ার।

নরসিংদীর প্রবীন সাংবাদিক, প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারন সম্পাদক নিবারন রায় বলেন, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, শিক্ষাসহ সব সেক্টরের জন্যেই কাজ করেছেন তিনি। নরসিংদীর উন্নয়নে তার ভূমিকা গুরত্বপূর্ণ। ধৈযর্য ও সাহসের সঙ্গে কাজ করে গেছেন তিনি। এজন্যে এখানকার মানুষ সবসময় তাকে মনে রাখবে।

নরসিংদী শিল্প ও বনিক সমিতির প্রেসিডেন্ট, এফবিসিসিআই’র পরিচালক মো. আলী হোসেন শিশির বলেন, এখানকার ব্যবসা-বানিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে তার উজ্জল পদচারনা ছিলো। শুধু বিজনেস কমিউনিটি নয়, সবমহলের জন্যে কাজ করে একজন সফল জেলা প্রশাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ‘কর্মসংস্থান নরসিংদী’ নামে তিনি নতুন থিম দাড় করিয়েছেন। যার মাধ্যমে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সকল কাযর্যক্রম তিনি এখানে সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন।

সিনিয়র সাংবাদিক মো. নূরল ইসলাম বলেন, নরসিংদীর মানুষের জন্যে তিনি যে কাজ করেছেন বিগত কোন জেলা প্রশাসক এই কাজ করেননি। যা বিরল। একজন স্নেহময়ী, মমতাময়ী মা ও বোন হিসেবে তিনি এখানে কাজ করে গেছেন।

জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সরকারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ভিন্নধর্মী কাজের জন্যে সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। নরসিংদীতে কাজের জন্যে সেরা জেলা প্রশাসকের পুরস্কার পান। ‘কর্মসংস্থান নরসিংদী’ নামক বিশেষ উদ্যোগের জন্যে ব্যক্তিগত ক্যাটাগরিতে ২০১৯ সালে ‘জনপ্রশাসন পদক’ দেয়া হয় তাকে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছ থেকে এই পদক গ্রহন করেন তিনি।

প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ‘জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক-২০১৮’ গ্রহণ করেন। শুদ্ধাচার চর্চায় অবদানের জন্য শুদ্ধাচার পুরষ্কার ২০২০ এবং ২০১৯ সালে ‘নরসিংদী জেলার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় নরসিংদী’ নামক সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী উদ্যোগের জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে ইনোভেশন শোকেসিং ২০১৯ এ প্রথম স্থান অর্জন করেন। সর্বশেষ পেয়েছেন ‘‘জাতীয় ডিজিটাল পুরস্কার ২০২০’’। ২০১৮ সালে তথ্য অধিকার চর্চার বিভিন্ন সূচকে সন্তোষজনক অবদানের জন্যে সারাদেশে ২য় হয় নরসিংদী জেলা।

এরআগে ২০১৩ সালে নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগের অন্যতম ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে বিশেষ অবদানের জন্যে জাতীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা’ নির্বাচিত হন সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এই সম্মাননা পদক গ্রহন করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কন্যা সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা হিসেবে ২০০১ সালের ২৮ মে সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ে কর্মজীবন শুর করেন। তার পিতা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রথিতযশা আইনজীবি প্রয়াত সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং গণপরিষদের সদস্য।

তার স্বামী মো. সায়েদুর রহমান বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি। চাকরি সূত্রে ফেলোশীপসহ বিভিন্ন উচ্চতর প্রশিক্ষনে অংশগ্রহণে যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারত সফর করেন। ২০১৮ সালে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের আগে তিনি ঢাকা কালেক্টরেটে এডিসি এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ে উপসচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

নরসিংদীতে যোগদানের পর প্রশাসকের নিয়মিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ভিন্নমাত্রার কাজের জন্যে প্রশংসিত হয়ে উঠেন তিনি। জেলার বেকার যুবক যুবতীর কর্মসংস্থানে তার গৃহিত উদ্যোগে এখন পর্যন্ত ৫’শ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। কর্মসংস্থানের এই উদ্যোগকে টেকসই করতে কর্মসংস্থান নরসিংদী নামে ওয়েবসাইট, অ্যাপস ও ডাটাবেজ চালু প্রক্রিয়াধীন।

২০১৯ সালে মহান বিজয় দিবসে ‘মমতার পরশ’ নামে ৯৯ জন বীরগর্ভা মাকে শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করেন জেলা প্রশাসক ফারহানা। বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের মায়েদের সম্মানিত করার তার এ উদ্যোগ সবমহলে প্রশংসা পায়।
এছাড়া তার অধীনে পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেহারাও বদলে দেন তিনি। সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের সাংস্কৃতিক সংগঠন বাঁধনহারা থিয়েটার স্কুলের অত্যাধুনিক স্টুডিও থিয়েটার, হজরত কাবুল শাহ নরসিংদী কালেক্টরেট পাবলিক স্কুলের নতুন একাডেমিক ভবন নির্মান করা হয়। শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও বিনোদনের জন্য নির্মিত হয়েছে মিনি পার্ক।

শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রদান করা হয়েছে শিক্ষা উপকরণ। মেধাবী দরিদ্র, সুবিধা বঞ্চিত ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে ২০১৮ সালে জেলা প্রশাসক শিক্ষা বৃত্তি চালু করা হয়। ইতোমধ্যে ১১১৫ জন শিক্ষার্থীকে এ বৃত্তি প্রদানের জন্যে অন্র্—ভূক্ত করা হয়েছে।

এলজিএসপি প্রকল্পের অধীনে ৭৭টি স্কুলের সামনে অভিভাবক ছাউনি ‘ছায়া পরশ’ নির্মান করা হয়েছে। নরসিংদীর অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের জন্য নির্মিত হয়েছে অবসর ভবন। নরসিংদী ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালিত নরসিংদী ডায়াবেটিক হাসপাতালের অবকাঠামোগত উন্নয়নে তিন তলাবিশিষ্ট বর্ধিত ভবন করা হয়। সেখানে স্থাপিত হয়েছে কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার, চিকিৎসায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা হয়।

নরসিংদী প্রেস ক্লাবের আধুনিকায়ন এবং গ্রন্থাগার নির্মাণ করে দেন তিনি। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব এর নামে নির্মিতব্য ১০০০ শয্যাবিশিষ্ট অডিটরিয়ামের জন্য ১ একর জমি বরাদ্দ করা হয়। ৭০ বছর আগে নারী শিক্ষায় উদ্যোগী কৃতি নারী প্রিয়বালার নামে ‘প্রিয়বালা গুপ্তা স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে নরসিংদী সদর উপজেলার মহিষাশুরা ইউনিয়নের চৌদ্দপাইকা মৌজায় ৮১ শতাংশ জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরতে নরসিংদীতে ইমার্জেন্সি সেল করা হয়। যা দেশের অন্য কোন জেলায় গঠিত হয়নি। জাতীয় হটলাইন ৩৩৩ ও জেলা প্রশাসনের হটলাইনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অনুরোধে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে ত্রাণ পৌছে দেয়ার পাশাপাশি ছিন্নমূল মানুষের মুখে একটি রেস্টুরেন্টের মাধ্যমে অন্ন তুলে দিতে চালু করা হয় ‘একমুঠো আহার’ কার্যক্রম।