নির্বাচন নিয়ে কূটনীতির দৌড়ঝাঁপ

আসছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশ গ্রহণমুলক করার ‘মিশনে’ নেমেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দৌড়ঝাঁপ করছেন তারা। ইতিমধ্যে সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে প্রধান নির্বাচন কমিশনের (সিইসি) সঙ্গে একান্তে একাধিকবার বৈঠকও করেছেন কূটনীতিকরা। সিইসিও সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির সার্বিক বিষয় তুলে ধরছেন তাদের কাছে।

সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হঠাৎ করে কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ বৃদ্ধি পেয়েছে। কূটনৈতিকপাড়া ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। দৌড়ঝাঁপের পিছিয়ে নেই রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। জাতীয় সংসদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই চলছে নানা রকম আলোচনা ও শলাপরামর্শ। কেউ কেউ দূতিয়ালি করছে নিজ নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অতিরঞ্জিত পরামর্শ ও আগ্রহ সঙ্গত কারণেই ভালোভাবে নিচ্ছে না ক্ষমতাসীনরা। এ বিষয়ে সরকার বিশেষ সতর্কতা বজায় রাখছে। কারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনসহ নয়া মেরুকরণ হতে পারে।

জানা গেছে, নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের আগ্রহ সব সময় থাকলেও এবারই প্রথম নির্বাচন কমিশন নিয়ে তারা ‘বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ’ করেছে। তাই এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা রকম সমীকরণ। একটি রাজনৈতিক সূত্র আভাস দিয়েছে, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে অনেক চমক সৃষ্টি হতে পারে। রাজনৈতিক মেরুকরণে নতুনত্ব আসতে পারে। আর সেই চমকের অন্যতম বিষয় থাকবে গণেশ উল্টে যাওয়ার মতো ঘটনা। অর্থাৎ দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতকে ছাড়াই জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারে বিএনপি জোট।

এদিকে গত বুধবার ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে. এম. নুরুল হুদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সবার অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তার এই অবস্থানের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সিইসি। বার্নিকাট বলেছেন, বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন আর নয়। এ জন্য এখন থেকেই কাজ শুরু হয়েছে। বুধবার বেলা সাড়ে ১২টায় আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে। এর আগে গত ১৮ মে সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতের হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। গত ১২ মার্চ নতুন নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নরওয়ে ও সুইডেনের রাষ্ট্রদূত। সব বৈঠকে আলোচনার মূল বিষয় ছিল আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কূটনীতিকরা আগামী নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ চান। সেইসঙ্গে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসিকে সহযোগিতার কথাও বলেছেন কূটনীতিকরা।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলেছেন, নির্বাচন কমিশন যেহেতু আগামী সংসদ নির্বাচনের খসড়া রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, তাই নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের আগ্রহ বেড়ে গেছে। তারা এখন নির্বাচন কমিশন মিশনে নেমেছে। আর ইসির কর্মকর্তারা বলেছেন, সময়মতো আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইসি ইতিমধ্যে রোডম্যাপ তৈরি করেছে। আর রোডম্যাপে নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে সময়সীমাও নির্ধারণ করা হয়েছে। ইসি সেই অনুযায়ী কাজ করছে। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে. এম. নুরুল হুদার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ভারতের হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। সেই বিষয়ে সিইসি বলেছেন, এটা একটা সৌজন্য সাক্ষাৎ। অনেক রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে, ভারতীয় হাই কমিশনারও এ ধারাবাহিকতায় এসেছিলেন। সাক্ষাৎকালে নির্বাচন নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে।

পরে সিইসি সাংবাদিকদের জানান, আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন, কবে নাগাদ নির্বাচন হতে পারে, ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া নির্বাচনগুলো নিয়ে পরস্পরের কথা হয়েছে। আমরা তিন মাসে যেসব নির্বাচন করেছি এগুলো ভালো হয়েছে বলে জানান হাই কমিশনার। আমিও বলেছি, জাতীয় নির্বাচনের জন্য আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিতসময়ের মধ্যে (২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে আগের ৯০ দিন) ভোট করতে প্রস্তুত আমরা। ৫ সদস্যের ইসির মধ্যে সিইসির সঙ্গে ওই বৈঠকে অন্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিবালয়ের কেউ উপস্থিত ছিলেন না।

প্রসঙ্গত, বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ব্যাপক তৎপর ছিলেন কূটনীতিকরা। তারাও একাধিকবার তখনকার রকিব কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকরা তৎপর হন। ইতিমধ্যেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু।

ঢাকায় এসব কূটনৈতিক তৎপরতা শুরুর আগেই গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতরের বাংলাদেশ-ইইউ রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। পররাষ্ট্র সচিব সেখানে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ করে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়।

জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূতিয়ালিতে বেশ সরব রয়েছেন। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, আমরা বন্ধু, শুভাকাঙ্খাক্ষী হিসেবে চাইব বাংলাদেশে যেন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। সেটিই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে।

তবে দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনীতিকদের অযাচিত নাক গলানো অনেকটাই স্বাধীনতা এবং দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল। সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য নিয়ে তাদের জোরালো মন্তব্য অনেকটাই ইঙ্গিতপূর্ণ।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, আমাদের কোনো বিষয়ে কূটনীতিকরা মাথা ঘামাক এটি আমরা চাই না। এটা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য শুভ নয়। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন হয় কি না, আমার জানা নেই। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে বিদেশিদের আশীর্বাদ নিতে চায় বলেই হয়তো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।