নেই কঠোর নির্দেশনা, স্বাস্থ্যবিধি সবাই জানে কিন্তু মানে না
দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গত ২৯ ও ৩০ মার্চ টানা দুইদিন নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত রোগী পাঁচ হাজারের বেশি। ২৯ মার্চ পাঁচ হাজার ১৮১ জন এবং ৩০ মার্চ ছিল পাঁচ হাজার ৪২ জন। এ নিয়ে দেশে শনাক্ত হওয়া মোট রোগীর সংখ্যা ছয় লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এটিই এ যাবতকালের একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা। এর আগে গত বছরের ২ জুলাই চার হাজার ১৯ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল।
করোনায় গত টানা দুদিন ৪৫ জন করে মোট ৯০ জনের মৃত্যু হয়। গত বছরের ১৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু হয়। ৩০ মার্চ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৯৯৪ জনে।
স্বাস্থ্য বিধি মেনে না চললে সামনে মহাদুর্যোগ হতে পারে আশঙ্কা করে রোগতত্ত্ব ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অব্যাহতভাবে নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হলেও তাদের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন যথাযথভাবে হচ্ছে না। রোগী শনাক্ত হওয়ার পর মোবাইল ফোনে রোগীর সঙ্গে কথা বলে কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজটি করে থাকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। মোবাইল ফোনে এ কাজটি করার জন্য আইইডিসিআরে চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ১০/১২জন। কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংসহ রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে যে প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়েছে তা ফলো করে একেকজন রোগীর তথ্য সংগ্রহে ১০/১৫ মিনিট সময়ও লেগে যায়। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকরা বড় জোর দৈনিক ১০০ জন রোগীর তথ্য সংগ্রহ করতে পারছেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে যে ক্রমবর্ধমান হারে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে জনবলের অভাবে সঠিকভাবে কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করা যাচ্ছে না! পরিস্থিতি সামাল দিতে জরুরিভিত্তিতে চুক্তিভিত্তিক হলেও কমপক্ষে ১০০ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোগীদের ক্লিনিক্যাল ফলোআপের কাজটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস শাখাও করে থাকে। কিন্তু প্রতিদিনই এত বিপুল সংখ্যক রোগী শনাক্ত হওয়ার ফলে তাদের পক্ষেও রোগীর ক্লিনিক্যাল ফলোআপ করা সম্ভব হচ্ছে না। রোগী শনাক্ত হওয়ার পর পরই তার সঙ্গে কথা বলে চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করা ও নিয়মিত ফলোআপ করার কথা থাকলেও ১০দিন পরও তা করা সম্ভব হচ্ছে না। যখন তারা ক্লিনিক্যাল ফলোআপ করছেন তখন হয় রোগী সুস্থ হওয়ার পথে কিংবা ততক্ষণে মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা সোমবার (২৯ মার্চ) ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। আগে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে অধিক বয়স্করা বলা হলেও বর্তমানে আবালবৃদ্ধবনিতা কেউ নিরাপদ নয়। এহেন পরিস্থিতিতে দেশের শতভাগ মানুষের মাস্ক পরিধানসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে না চললে সমুহবিপদ।
করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি (ঘরের বাইরে বের হলে সার্বক্ষণিক মাস্ক পরিধান করা, ঘন ঘন সাবান বা ছাই দিয়ে হাত ধোয়া, কমপক্ষে দুই ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলা এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলা) মেনে চলা সর্বোৎকৃষ্ট উপায়- এ কথা রাজধানীসহ সারাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা কারও অজানা নয়।
দেশে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সর্বোচ্চ উচ্চারিত বাক্যগুলোর মধ্যে করোনা স্বাস্থ্যবিধি অন্যতম। জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা, কমিউনিটি রেডিও, জাতীয় রেডিও, টেলিভিশন, লিফলেট, পোস্টার ও দেয়াল লিখনসহ স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার কথা বলা হচ্ছে। করোনা স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সবাই জানলেও কারও মধ্যে মানার প্রবণতা নেই। কেউ কেউ বলছেন, করোনার সংক্রমণরোধে সরকার যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে তাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে মানুষকে বাধ্য করার কোনো কঠোর নির্দেশনা নেই।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বলছেন, করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতির লাগাম এখনই টেনে না ধরলে সামনে মহাদুযোর্গ। এ মুহূর্তে রোগী শনাক্ত হওয়ার পর কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং, তাদের আইসোলেশন ও নমুনা পরীক্ষার দ্রুত ব্যবস্থা, কোয়ারেন্টাইন ও কোয়ারেন্টাইনে থাকার সময় বিশেষত দরিদ্র রোগী ও তাদের পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, বর্তমানে শিক্ষিত অনেকেই চাকরি হারানোর ভয়ে করোনার উপসর্গ নিয়ে অফিস করছেন। তার মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে রোগের সংক্রমণ ঘটছে। দরিদ্র মানুষ যারা দিন আনে দিন খায় তারা কেউ পরীক্ষা করাতেই যাচ্ছে না। ফলে ঝুঁকি বাড়ছে।
ড. মুশতাক হোসেন বলেন, বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের হেলথ স্ক্রিনিং ও কোয়ারেন্টাইনের ব্যাপারে সরকার যতটা সিরিয়াস দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর কক্ট্রাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনে ততটা সিরিয়াস নয়।
এ ব্যাপারে সরকারের নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গ্রাম শহর নির্বিশেষে কমিউনিটি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার চালু করে সেখানে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন