পঞ্চগড়ে চা উৎপাদনে রেকর্ড ছাড়িয়েছে

সমতল ভূমিতে চা উৎপাদনে রেকর্ড ছাড়িয়েছে উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড় জেলা। শিল্প বিপ্লবে বদলে গেছে উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়। সিলেটের পরের অবস্থানে সুপরিচিতি পেয়েছে এ প্রান্তিক জেলা। দুই দশকের নীরব চা বিপ্লবে বদলে গেছে অর্থনীতি ও জীবনমানের চিত্র। কয়েক বছর ধরেই রেকর্ড হারে উৎপাদিত হচ্ছে চা।

গত বছর ২০২২ সালে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় (পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারী) চা উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ২শ’২৬ কেজি। যা বিগত বছরের তুলনায় ৩২ লাখ ১৯ হাজার ২২৬ কেজি বেশি উৎপাদনে সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে চা বোর্ডের জেলা আঞ্চলিক কার্যালয়।

চা বোর্ড জানায়, উত্তরাঞ্চলে বেড়েছে চা আবাদ। এবার ১২ হাজার ৭৯ দশমিক ৬ একর সমতল জমিতে ৩০টি বাগান ও ৮ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র চা বাগান থেকে চা উৎপাদন হয়ে রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ বছর এসব বাগান থেকে ৯ কোটি ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৩২ কেজি সবুজ কাঁচা চা পাতা উত্তোলন করা হয়। যা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটের চলমান ২৫ টি কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ২শ’২৬ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এই উৎপাদন জাতীয় উৎপাদনের ১৮.৯২ শতাংশ।

চা বোর্ডের তথ্য মতে, ২০২০ সালে উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়সহ পাঁচ জেলায় ১০ হাজার ১৭০ একর জমির ১০টি নিবন্ধিত ও ১৭টি অনিবন্ধিত চা বাগান ও ৭ হাজার ৩১০টি ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানে ৫ কোটি ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৩৮৬ কেজি সবুজ কাঁচা চা পাতা উত্তোলন করা হয়। সে পাতা থেকে ১৮টি চা ফ্যাক্টরিতে ১ কোটি, ৩ লাখ ১০ হাজার কেজি তৈরি চা উৎপাদিত হয়। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ১ হাজার ৪৯০ একর জমি নতুন করে চা চাষের আওতায় আসে। তৈরি চায়ের উৎপাদন বাড়ে ৭.১১ লাখ কেজি।

২০২১ সালে এ অঞ্চলে চা আবাদের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৩৩ দশমিক ৯৪ একর। উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি। সে তুলনায় গত এক বছরে চা আবাদ বেড়েছে ৬৪৫ দশমিক ১২ একর। উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মধ্যে পঞ্চগড়ে ১০ হাজার ২৩৯ দশমিক ৮০ একর জমিতে চা উৎপাদিত হয়েছে। অন্যান্য জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে ১ হাজার ৪৫৭ দশমিক ২৯ একর, লালমনির হাটে ২২২ দশমিক ৩৮ একর, দিনাজপুরে ৮৯ একর ও লালমনিরহাটে ৭০ দশমিক ৫৯ একর জমিতে এই চা আবাদ হচ্ছে। যা ২০২২ সালে বিগত বছরের তুলনায় ৩২ লাখ ১৯ হাজার ২২৬ কেজি চা উৎপাদন বেশি হয়েছে।

এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি এখন সবুজ চা বাগান। সবুজ পাতায় জোগান দিচ্ছে সবুজ অর্থনীতি। এখানকার মানসম্মত উৎপাদিত চা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রবেশ করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। এখন সিলেটের পর চা উৎপাদনে দ্বিতীয় অঞ্চল হয়ে উঠেছে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে পঞ্চগড়ের চা শিল্পের বিপ্লবকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলা।

চা শিল্প ঘিরে এ জেলায় ২০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। গড়ে উঠছে দেশের চায়ের তৃতীয় নিলাম মার্কেট। আগামী এপ্রিলের মধ্যে উদ্বোধন হতে পারে বলে জানা গেছে। জেলার ধাক্কামারায় তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রত এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে চা ওয়্যার হাউজ, ব্রোকার হাউজসহ সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণ করে প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ চা-বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরামর্শে গড়ে উঠছে ওয়্যার হাউজ, ব্রোকার হাউজ, টি টেস্টিং ল্যাব, বায়ার কমফোর্ট জোন। প্রস্তাবিত চা নিলাম কেন্দ্রের অবকাঠামোও প্রস্তুত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের জেলা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন, ‘সমতল ভূমিতে চা চাষে উত্তরাঞ্চলের জেলা ৫টি জেলা অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। ১৯৯৬ সালে এ জেলায় প্রথম চা চাষের পরিকল্পপনা হাতে নেওয়া হয়। ২০০০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষ। এ অঞ্চলে দিনদিন চা চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে তা আজ সিলেটের পর দ্বিতীয় অবস্থানে পরিচিতি পেয়েছে। পঞ্চগড়ের চা শিল্পকে অনুসরণ করে ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও নীলফামারীতে চা উৎপাদনে সমৃদ্ধ করেছে রংপুরের পাঁচ জেলা।

তিনি আরও বলেন, চা শিল্পে এ অঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে। চা বোর্ড চা চাষ সম্প্রসারণে চাষিদের বিভিন্ন সহায়তার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। উন্নত জাতের উচ্চ ফলনশীল ও গুণগতমান সম্পন্ন বিটি সিরিজের চা চারা উৎপাদনের কাজ অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের আওতায় ৮.২১ লাখ চা চারা চাষিদের মাঝে সল্পমূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।

আর চাষীদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিতে ‘ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল’র মাধ্যমে কর্মশালা করা হচ্ছে। চাষিদের সমস্যা সমাধানে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপস চালু করা হয়েছে। এছাড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ে একটি পেস্ট ম্যানেজমেন্ট ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে চাষিদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, রোগবালাই ও পোকা দমনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সহায়তা দেওয়া হয়।’