পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটে সেবা থেকে বঞ্চিত রোগীরা!
‘পাবনা মানসিক হাসপাতাল’ দেশের একমাত্র বিশেষায়িত মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্র। নানা চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে কালের স্বাক্ষী হয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে এই বিশেষায়িত হাসপাতালটি। প্রতিষ্ঠার পর ভিন্নভিন্ন পরিবর্তনের ছোঁয়া আসলেও নানা সমস্যার কারণে কাঙ্খিত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত ভূক্তভোগীরা। হাসপাতাল প্রশাসন, চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকটের বিষয়টি বারবার প্রাধান্য দিয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৩০০ রোগী ও স্বজনদের আনাগোনা থাকে হাসপাতাল ক্যাম্পাসের আউটডোরে। পুরাতন জীর্ণশীর্ণ কয়েকরুম বিশিষ্ট একটি ভবনেই চলছে প্রাথমিক রোগী বাছাই ও জরুরী চিকিৎসাসেবা প্রদান কার্যক্রম। প্রাকৃতিক বৈরী ঝড়ো হাওয়া বা বৃষ্টিতে আগত রোগী ও তার স্বজনদের আশ্রয়ের নেই কোন নির্ধারিত স্থান।
রোগীর স্বজনদের দাবী, অল্প জায়গাতে অনেক বেশি লোক সমাগম হওয়ায় বর্তমান জীবননাশী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি আর ঠেলাঠেলিতে ভয়ংকর পরিবেশ তৈরী হয়। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম আরও বিরক্তকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
আগত মানুষগুলোর তত্বাবধানে থাকা আনসার সদস্যদের রুঢ় আচরণে রোগীর স্বজনেরা অনেকেই ব্রিবত। তাদের সাথে চলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ব্যবহার। গোপণে কিছু অর্থ হাতে ধরিয়ে দিলেই খুব সহজেই জরুরী বিভাগের টিকিট পাওয়া ও ডাক্তার দেখানো সম্ভব বলে অভিযোগ রোগীর সাথে আসা স্বজনদের।
নাটোর, কুষ্টিয়া, রংপুর, রাজবাড়ি, সিরাজগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলা থেকে আগত মানসিক রোগীর স্বজনদের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, রোগী দেখাতে এসে নানা হয়রানীর শিকার হতে হয়। শহরের পৈলানপুর থেকে কাশিপুর মোড় এবং হাসপাতালের মেইন গেটের ভেতর পর্যন্ত চলে দালালদের অব্যাহত দৌরাত্ম। এই দালালদের সাথে সখ্যতা রয়েছে স্থানীয় অটোবাইক চালক ও আনসার সদস্যদের।
হাসপাতালের ইনডোরে বেশ কয়েকটি পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ড ঘুরে কথা হয় দায়িত্বরত নার্স, সুপারভাইজার ও চিকিৎসা নিতে এসে ভর্তি হওয়া নারী-পুরুষ রোগীদের সাথে। নারী ওয়ার্ডে কথা হয় নেত্রকোনার রোখসানা খাতুনের (৩৭) সাথে। তিনি বলেন, নার্সরা আন্তরিক। তারা তার পিতা-মাতা, ভাই-বোনের মতো। এখন সে সুস্থ। তাহলে কেন তার পরিবার নিয়ে যাচ্ছে না। সে বাড়ি যেতে চায়। তারাতো সবাই এসে তার সাথে সাক্ষাত করে। তাহলে বাড়ি নিতে সমস্যা কোথায়? যশোরের সাবিনা ইয়াসমিন (৪১)। সুন্দরভাবে কথা বলে। গুছিয়ে গুছিয়ে। তারপরও তার নাকি মাথায় উপর থেকে ডিস্টাব করে। সেই সময়ে সে এলোমেলো হয়ে পড়ে। সে বলে আমি ইন্টার পাস। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করেছি। একটু সমস্যার জন্য ডাক্তার দেখাতে এসে তার পরিবার রেখে গেছে। নেয়ার কোন নাম নেই।
নারী ওয়ার্ডের সুপারভাইজার রাশেদা খাতুন বলেন, এদেরকে সন্তানের মতো লালনপালন করতে হয়। এরা যখন কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। তখন খারাপ লাগে। ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে কেউ কেউ খারাপ আচরণ ও মারধরও করে। তারপরও ওদের সকল জ্বালা সহ্য করে ওদের পাশেই রয়েছি।
কয়েকটি পুরুষ ওয়ার্ড ঘুরে দেখার পর ৫ নং ওয়ার্ডে কথা হয় পাবনার মোক্তাহিদ ইকবালের (২২) সাথে। তার কাছে নার্স, সেবা সবকিছুই ভালো লেগেছে। কিন্তু তাকে কেন আটকে রাখা হয়েছে লোহার খাঁচা বন্দি করে। এটাই তার প্রশ্ন। সে বাড়ি ফিরতে চায়। বাবা মার সাথে থাকতে চায়। কিন্ত কি যেন সমস্যার জন্য তাকে এখানে আটকে রাখা হয়েছে। কথা হয় পিরোজপুরের রব্বানী নেওয়াজ (২৩) এর সাথে। সেও বাড়ি ফিরতে চায়। কিন্তু সিস্টার ব্রাদাররা তাকে আটকে রেখেছে। প্রতিদিন খেতে দেয়। ওষুধও দেয়। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার কথা বললেই কেউ কোন কথা বলে না কেন? ১১ বছর ধরে রয়েছে মতলবের সৌরভ। সেও বাড়ি যেতে চায়। তার সবাই আছে। কিন্তু বাড়ি থেকে কেউ নিতে আসে না।
পুরুষ ওয়ার্ডের নার্সিং সুপারভাইজার আব্দুল কাদের বলেন, পুরুষ ওয়ার্ডে পুরুষ নার্স বেশ সংকট। কিছু সংখ্যক নার্স দিয়ে চালানো হচ্ছে। ফলে কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পুরুষ রোগীরা। পুরুষ রোগীদের সব কাজ তো নারী নার্স দিয়ে করানো সম্ভব নয়। তাছাড়া মেয়েদের চেয়ে ছেলে রোগীগুলো কিছুটা উত্তেজিত ও আক্রমনাত্মক হওয়ায় নারী নার্সরা এগিয়ে যেতে সাহস পান না। এ জন্য পুরুষ নার্স বিশেষ প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, আমরা মানসিক রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে অনেক সময় বড় ধরণের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাই। এ জন্য আমাদের ঝুঁকি ভাতা চালু করার দাবী জানান তিনি।
মানসিক রোগীদের নার্সিংয়ের বিষয়ে বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ নার্সের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, তিন শিফটে তারা ডিউটি করেন। সকাল শিফটে নার্সের সংখ্যা কিছুটা বেশি থাকে। দুপুরে কমতে থাকে। আর রাতে একেবারেই কম নার্স দিয়ে ডিউটি করানো হয়। বিশেষ করে নারী নার্সের চেয়ে পুরুষ নার্সের বিশেষ প্রয়োজন সেবা দেয়ার জন্য পুরুষ ওয়ার্ডে। ওয়ার্ড প্রতি যে পরিমান নার্স প্রয়োজন তার তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে চালানো হলে সেবা প্রদানে অনেকটাই মন্থরগতি হবে এটাই স্বাভাবিক।
মানসিক রোগীদের চিকিৎসার সাথে জড়িত একাধিক চিকিৎসকের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, আউটডোরে জরুরী বিভাগে রোগী দেখার সময়ে খবর আসে ইনডোরে রোগীর খারাপ অবস্থা। তখন আউটডোরের রোগী দেখা বাদ দিয়ে ইনডোরে আসলে অনেকটা চাপের মধ্যেই পড়ে থাকতে হয়। অল্প সংখ্যক চিকিৎসকের কারণে সন্তোষজনক চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হয়ে উঠেনা।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্ট মোঃ মাসুদ রানা সরকার জানান, পর্যাপ্ত চিকিৎসক প্রয়োজন। অথচ ৩ জন সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে এই হাসপাতালের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তন্মধ্যে একজন চিকিৎসক পাবনা মেডিকেল কলেজের। চিকিৎস সংকট দুর হলে অবশ্যই রোগীকে কাঙ্খিত চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব।
আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাঃ মোঃ শাহীন রেজা বলেন, ৫০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল হলেও অনেক সংকট রয়েছে। এই সংকটের মধ্যেই আমরা সমস্যা নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে সংকট নিরসন হলে অবশ্যই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব বলে তিনি দাবী করেন।
আর পাবনা মানসিক হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডাঃ রতন কুমার রায় বললেন, যতটুকু আছে সেটুকু দিয়েই ভালমানের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। সংকট নিরসনে ডিসি অফিসের মিটিং এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে। আশা করছি সরকার এই প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক মানের করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সেটি বাস্তবায়ন হলে চিকিৎসা সেবার মান আরও বৃদ্ধি পাবে।
হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্মের বিষয়ে তত্বাবধায়ক বলেন, আমরা অনেক বলেছি। কাজ হয়না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিষয়টি জানানো হয়। তারা মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে দালালদের আটক করলেও রাজনৈতিক তদবির, স্থানীয় আধিপত্য আর প্রভাবশালীদের কারণে ছেড়ে দেয়া হয়। দালাল নির্মূলে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর হস্তক্ষেপ চান তিনি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে মোট পদের সংখ্যা ৬৪৩টি। মঞ্জুরী পদ রয়েছে ৪৪৭ টি আর শুন্য পদের সংখ্যা ১৯৯ টি। চিকিৎসকের পদ ২০, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদ ৩ টি, দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার পদ ১টি, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর পদ ২১ টি ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ১০০ টি পদ শুন্য রয়েছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন