প্রশ্নফাঁস : অনেকে আটক হলেও অধরা হোতারা

চলমান এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক থেকে শুরু করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ব্যাংকার, অনলাইনে প্রশ্ন ছড়িয়ে দেয়া কাজে জড়িত বহু মানুষই ধরা পড়েছে। প্রায় ১০০ জনের মতো আটক হয়েছে। কিন্তু এদের মাধ্যমে এখনও হোতাদের শনাক্ত করে আটক করতে পারেনি ‍পুলিশ।

পুলিশ জানতে পেরেছে, ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে প্রশ্ন পাঠানোর সময় ছবি তুলে তা পাঠানো হয় কয়েকজনের কাছে। পরে তা ছড়িয়ে দেয়া হয় সামাজিক সাধ্যমে। তবে কারা এই কাজটি করে, তারা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস গত কয়েক বছর থরেই আলোচিত বিষয়। তবে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষার মতো তোলপাড় এর আগে হয়নি। পরীক্ষা শুরুর আগে এবং শুরুর দিন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মরিয়া মনোভাবের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

এর মধ্যে গঠন করা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের অনুসন্ধান কমিটি। কাজ শুরু করে গোয়েন্দারাও। একের পর এক নির্দেশনা জারি হয়, আবার বাতিলও হয়।

এটা স্পষ্ট, এবার প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে সরকারের দৃশ্যমান তৎপরতা আছে। আর এর অংশ হিসেবে ঢাকায় তিন ভাইসহ ১৪ জন, জামালপুরে ১০ জন ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধরা পড়েছে বহুজন। প্রশ্ন ফাঁসে ব্যবহার করা ৩০০ মোবাইল ফোন নম্বর শনাক্ত হওয়ার পর সেগুলো ব্লক করা হয়েছে।

এর মধ্যে ১৮ ফেব্রুয়ারি রবিবার বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, কৃষি শিক্ষা, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান ও সঙ্গীত, আরবি, সংস্কৃত, পালি, কর্মমুখী শিক্ষা, কম্পিউটার শিক্ষা, শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া, বেসিক ট্রেড, চারু ও কারুকলা বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্ন সামাজিক মাধ্যমে আসেনি। গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় প্রথমবারের মতো এই ঘটনা ঘটল।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘মূল হোতারা ধরা না পড়লে তো বন্ধ হবে না। কারণ সেরকম কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।’

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এই অধ্যাপক বলেন, ‘এখন যারা ধরা পড়ছেন তারা সবেচেয়ে নিচের স্তরের। এসব শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ধরে তেমন লাভ হবে না।’

তবে পুলিশ বলছে, এই অপরাধের সঙ্গে অনেক বড় একটা চক্র জড়িত। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে অনেক দিন ধরেই অভিযান চলছিল। গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পরদিন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন সংবাদ সম্মেলনে জানান, আটকেদের মধ্যে আমান উল্লাহ, আহসান উল্লাহ্ এবং বরকত উল্লাহ তিন ভাই। ফেসবুকে যারা প্রশ্ন দেয়ার ‘বিজ্ঞাপন’ প্রচার করতেন, তাদের মধ্যে এই তিনজন আছেন।

সেদিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ‘প্রশ্ন যখন পরীক্ষার হলে পাঠানো হয়, তখন ওই সময়টাতে কেউ এর ছবি তুলে আসামিদের পাঠায়। এই সময়টা পরীক্ষার ৩০-৪০ মিনিট আগে।’

এই চক্রটি কারা, সেটি এখনও জানতে পারেনি অথবা প্রকাশ করেনি পুলিশ। তবে কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার দাবি করছেন কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বলেন, ‘আমরা প্রথমে যার কাছে প্রশ্ন পাই তাকে ধরি। সে জানায় কার কাছ থেকে প্রশ্ন পেয়েছে। আমরা তখন তাকে ধরি। এভাবে পুরো লিংকটা ধরার চেষ্টা করা হয়। সেজন্য অনেকগুলো স্টেজ পার করতে হয়। কিন্তু অনেক সময় পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে পুরো চক্রটি ধরা সম্ভব হয় না। তাই মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তবে আমরা মূল হোতাদের ধরে ফেলব।’

এ বিষয়ে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার শারমিন জাহান বলেন, ‘আমরা তো আসলে জানি না কারা মূল হোতা। জানলে তো তাদের ধরেই ফেলতাম। তবে তাদের ধরার চেষ্টা চলছে। অচিরেই ভাল সংবাদ দিতে পারব।’

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে আমরা নতুন নতুন কোনও পথ খোঁজার চেষ্টায় আছি। মন্ত্রণালয় কাজ করছে।’

প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা খতিয়ে দেখতে গত ৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি উচ্চ পর্ায়ের তদন্ত কমিটি করেছে। সেই কমিটি আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দেবে।

এরই মধ্যে কমিটির প্রধান মো. আলমগীর জানিয়েছেন, একটি পরীক্ষার প্রশ্ন পুরোপুরি এবং বেশ কিছু পরীক্ষার প্রশ্ন আংশিক প্রকাশ হয়েছে।

এর বাইরে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা তদন্তে হাইকোর্ট ১৫ ফেব্রুয়ারি দুটি কমিটি করে দিয়েছে। বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদের নেতৃত্বে প্রশাসনিক কমিটি এবং ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে বিচারিক তদন্ত কমিটিকে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে কমিটিকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

তবে অধ্যাপক কায়কোবার জানিয়েছেন, আদালতের আদেশ এখনও তিনি পাননি। যদিও গণমাধ্যম জেনে নিজেদের মধ্যে একটি বৈঠক করেছেন।