বহু ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সাক্ষী আশুরা

বহু ঐতিহাসিক ঘটনাবলীতে প্রসিদ্ধ মহররমের আশুরার দিন

আলহাজ্ব প্রফেসর মো. আবু নসর

আরবি বর্ষপঞ্জি হিজরী সনের প্রথম মাস মহররম। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। মহররম মাসের দশ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আশুরা শব্দটি আরবি শব্দ আশারা থেকে এসেছে। আশারা মানে দশ এবং আশুরা অর্থ হলো দশম। হাদিস শরীফে চান্দ্র বর্ষের বারো মাসের মধ্যে মহররমকেই শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে সুরা তাওবার ৩৬নং আয়াতাংশে উল্লেখ আছে আরবায়াতুন হুরুম অর্থাৎ অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস হলো জিলকদ, জিলহজ, মহরম ও রজব।

মহররম মাসের আশুরার দিনটি সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিনেই পৃথিবীর বহু উল্লেখযোগ্য, স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস প্রসিদ্ধ ও অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়। ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্যে এইদিনে- ১. পৃথিবীর সৃষ্টি এবং ধ্বংস অর্থাৎ আল্লাহ পাক লওহে মাহফুজ ও প্রাণিকুলের প্রাণ সৃষ্টি করেছেন, দুনিয়ার সমস্ত সমুদ্র-মহাসমুদ্র ও পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টি তথা পৃথিবীর সৃষ্টি এবং একই সাথে ধ্বংস, ২. হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা ও একই দিনে জান্নাতে প্রবেশ, ৩. একই দিনে হযরত আদম (আ.) কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ এবং গুনাহ মার্জনার পর তাকে ও বিবি হাওয়াকে আরাফাতের ময়দানের জাবালে রহমতে পূনঃসাক্ষাৎ লাভ, ৪. ১৮ বছর রোগ ভোগের পর হযরত আইউব (আ.) কে রোগমুক্তি দান, ৫. হযরত ইদ্রিস (আ.) কে আকাশে উত্তোলন, ৬. হযরত নূহ (আ.) কে তুফান ও প্লাবন থেকে পরিত্রাণ দান, ৭. হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে দুনিয়াতে আগমন ও পরবর্তীতে একই তারিখে অগ্নিকুন্ড থেকে নিস্কৃতি প্রদান, ৮. হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.) কে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক কুরবানীর হুকুম, ৯. হযরত দাউদ (আ.) কে বিশেষ ক্ষমা প্রদান, ১০. হযরত সোলায়মান (আ.) কে স্বীয় হারানো বাদশাহী প্রদান করা, ১১. হযরত ইউনূস (আ.) কে ৪০ দিন পর মাছের উদর বা পেট থেকে উদ্ধার, ১২. হযরত ইয়াকুব (আ.) এর স্বীয় হারানো পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.) সঙ্গে সাক্ষাত লাভ, ১৩. এদিনে হযরত মুসা (আ.) কে আক্রমন করতে গিয়ে নীল নদে ডুবে ফিরাউনের মৃত্যু তথা ফিরাউনের কবল থেকে মুসা (আ.) এর নিষ্কৃতি লাভ, ১৪. হযরত ঈসা (আ.) এর দুনিয়ায় আগমণ ও আকাশে উত্তোলন, ১৫. প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা শরীফ থেকে হিজরত করে মদীনা শরীফে আগমন, ১৬. জালিম এজিদের সৈন্য কর্তৃক কারবালা প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার ৭৭ জন পরিজন, ঘনিষ্টজন নির্মমভাবে শহীদ বরণ যা ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা, ১৭. তুর পাহাড়ের পাদদেশে হযরত মুসা (আ.) এর আল্লাহ পাকের সাথে কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন এবং মুসা (আ.) এর নবুওয়াতি ও তাওরাত কিতাব লাভ, ১৮. এইদিনে নবীকুল শিরোমনি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রথম ওহি প্রাপ্ত হন, ১৯. এইদিনেই আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে সর্বপ্রথম রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করেন, ২০. আল্লাহ পাকের নির্দেশ অনুযায়ী এই তারিখে হযরত ইসরাফিল (আ.) সিঙ্গায় ফুক দিয়ে কেয়ামত ঘটাবেন।
এছাড়া মহররম মাসে ফেরেশতাদের দ্বারা প্রথম সৃষ্ট মুসলমানদের পূন্যভূমি কাবাগৃহ তৈরী করা হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, মহররম মাসের ১০ তারিখ দিনটিতে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও ন্যায় সত্য আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের মহিমান্বিত স্মৃতিবিজড়িত কারবালার শোকাবহ মর্মস্পর্শী হৃদয় বিদায়ক ও বিষাদময় ঘটনা সংঘটিত হয়। ৬৮০ খৃষ্টাব্দ, ৬১ হিজরী সালে ১০ মহররম আশুরার দিনে ইরাকের কুফা নগরীর অদুরে ফোরাত নদীর তীরবর্র্র্র্র্তী কারবালা প্রান্তরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) বিশ্বাসঘাতক অত্যাচারী শাসক এজিদের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পরিবার পরিজন ও ৭৭ জন সঙ্গীসহ নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন।

মূলত: কারবালায় হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর মৃত্যু ঘটেনি, প্রকৃত মৃত্যু ঘটেছে পাপিষ্ট এজিদের। কারণ যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন ঘৃণা, নিন্দা, বিদ্বেষ, ধিক্কার ও অভিশাপ চলতে থাকবে এজিদ ও তার বাহিনীর উপর। পক্ষান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)কে দরুদের মাধ্যমে স্মরণ রাখবে সারা মুসলিম জাতি। এভাবে আজীবন সত্য, আদর্শ এবং ন্যায়, সততার বিজয় উদ্ভাসিত হবে।

দশই মহররম আশুরার দিনে বিষাদ সিন্ধু সম্বলিত কারবালার নির্মম ঘটনা ইসলামের জন্য আত্ম্যাগের দীক্ষা ও শিক্ষা। অন্যায়কে প্রতিহত করে সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার শিক্ষা আমরা কারবালার ঘটনা থেকে গ্রহন করতে পারি। জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে তারা ন্যায়, সত্য ও আদর্শকে চিরভাস্বর করে রেখে গেছেন। সেই হৃদয়ভাঙ্গা বেদনাকে স্মরণ করে ১০ই মহররম মুসলিম বিশ্ব কারবালার শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে ইবাদত বন্দেগী করেন।
মহররম ও আশুরার শিক্ষা হলো ত্যাগের মহিমায় নিজেকে উজ্জিবীত করা, সত্য ও ন্যায়ের অনুসরণ এবং অসত্যকে বর্জণসহ অন্যায়ের প্রতিবাদে দৃঢ় প্রত্যয়ী হওয়া, ষড়ঋপু নিয়ন্ত্রণে ব্রতী হওয়া (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য), নিষ্কাম কর্ম করা, আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল করা, তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের জন্য প্রস্তুত থাকা।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন- ‘রমজানের রোজার পরে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।’
হযরত হাফসা (রা.) বলেন, ‘রাসুলে পাক (সা.) চারটি কাজ কখনো ত্যাগ করেননি। যথা- ১. আশুরার রোজা, ২. জিলহজের প্রথম ৯ দিনের রোজা, ৩. আইয়ামে বিজের রোজা তথা প্রতিমাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোজা এবং ৪. ফজর ওয়াক্তে ফরজের পূর্বে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ।’
উল্লেখ্য যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেছেন, মহররম মাসের আশুরার দিনে রোজা রাখলে পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ ও গুনাহ আল্লাহ মোচন করে দেন। আমাদের এ মাসে রাসসুল্লাহ (সা.) এর প্রতি অধিক দরুদ ও সালাম পেশ, নফল নামাজ, কোরআন মজিদ তেলাওয়াত, আশুরার দিনে এবং অন্যদিনেও রোজা পালন হাদীস শরীফ অধ্যয়ন, দান-সাদকাহ ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বিশেষভাবে ইসলামের কল্যানে জীবনকে নিবেদিত করা উচিত।

আশুরার রজনী এক মহিমান্বিত সম্মানিত, বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, পূন্যময়, বরকতময় ও মহা পবিত্র রজনী। এ রজনীতে উম্মতী মুহাম্মদীদের সম্মান বৃদ্ধি করা হয়। এ রজনীর শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম সর্বাধিক ও সুদুরপ্রসারী। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হলো ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা। ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চা না থাকলে সমাজে কেউ নিরাপদ নয়। মহররম সকল অন্যায়, পাপাচার, দুরাচার ও সহিংসতাকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের মানসিক, দৈহিক ও আত্বিকভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়।

মহররম হিজরী সনের ফজিলত ও শিক্ষার মাস। আতœসচেতনতার মাস। মুসলমানদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার মাস। মহররম আসে অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার, সাহসিকতার পথ প্রদর্শক হিসেবে। মহররম আসে নির্ভীক পথ চলার কল্যাণময় শুভ বার্র্তা নিয়ে। মহররম আসে আমাদের পুরাতন বছরের জরাজীর্নতাকে ধুয়ে মুছে নতুনরূপে নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে। মহররম আসে আমাদের নতুন শপথ ও প্রত্যয় গ্রহনের অঙ্গীকার নিয়ে। মহররম যেন অফুরন্ত জয়ের দূরন্ত সূচনা।

 

লেখক:
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
সাবেক কলেক পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড।
সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, বাংলাদেশ।
মোবা: ০১৭১৭-০৮৪৭৯৩