বাংলাদেশের মহাকাশ যাত্রায় চিন্তিত ভারত?

সম্প্রতি দেশের প্রথম বাণিজ্যিক উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এই খাতে দীর্ঘদিন ধরে একক আধিপত্য ধরে রেখেছে ভারত। বাংলাদেশ মহাকাশের এ প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়ায় ভারতের কি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু আছে? এমন প্রশ্নের জবাব খোঁজা হয়েছে ভারতের প্রযুক্তিখাতের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এবং উদ্যোক্তার কাছে।

স্যাটেলাইট তথ্য বিশ্লেষণ সংস্থা স্যাটসিউর এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা, নর্দার্ন স্কাই রিসার্চের সাবেক বিশ্লেষক ও ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর সাবেক বিজ্ঞানী প্রতীপ বসু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টকে বলেন, চীন ধীরে ধীরে এবং কৌশলগতভাবে কূটনৈতিক পরিসর বাড়াচ্ছে এবং প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে সু-সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

‘এই অঞ্চলে ভারত এবং চীন মহাকাশের দুই পরাশক্তি। চীন সরকারের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু-১ এর চুক্তির ব্যাপারে অালোচনা হয়; প্রতিবেশির স্যাটেলাইট তৈরি এবং উৎক্ষেপণে ভারত একটি সুযোগ হাতছাড়া করেছে।’

সীমান্তের নানা ঘটনায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সম্প্রতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়েছে এবং মহাকাশ সরঞ্জামের উন্নয়নে সহায়তা একটি উপকারী কূটনৈতিক হাতিয়ার হতে পারে।

প্রতীপ বসু বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু-১ একটি কমিউনিকেশন ও ভিডিও সম্প্রচার স্যাটেলাইট। এটি সরাসরি হোম সার্ভিস সরবরাহ করবে। এটি বাণিজ্যিক খাতেও ব্যবহার করা যাবে; যা থেকে বাংলাদেশ সরকার মুদ্রা আয় করবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ যে সবসময় কার্যকরী তা কৌশলগতভাবে নিশ্চিত করবে।’

‘এই অঞ্চলের বেশ কিছু দেশে অতিথিদের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার নজির আছে। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে প্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণ ও ক্রমাগত সমবায়ভিত্তিক কাজও করা হয়। মহাকাশের সম্পদকে কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে প্রতিবেশিদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে ভারত। তবে চীন এতে সফল। এ বিষয়ে চিন্তা করার এখনই উপযুক্ত সময়।’

তিনি বলেন, ‘পারস্পরিক প্রবৃদ্ধির জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটকে দেখতে হবে, হুমকি হিসেবে নয়।’

অপেশাদার রকেট কোম্পানি রকেটিয়ারসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা দিবাংশু পোদ্দার বলেন, মহাকাশ শুধুমাত্র বড় বড় দেশগুলোর জন্য ধীরে ধীরে সহজগম্য হয়ে উঠছে না বরং ছোট ছোট দেশ, প্রাইভেট কোম্পানি এবং ব্যক্তির জন্যও সহজগম্য হয়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধু-১ এর উৎক্ষেপণ এর একটি প্রমাণ মাত্র। হুমকি এবং প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে বাংলাদেশকে না দেখে ভারতের উচিত পারস্পরিক প্রবৃদ্ধি এবং শেখার জায়গা থেকে এ সাফল্য দেখা।

তিনি বলেন, ‘মহাকাশ যাত্রায় ভারতের ৫০ বছরের রেকর্ড রয়েছে। মহাকাশে প্রযুক্তি মোড়লদের কাতারে রয়েছে ভারত। কিন্তু নিয়ন্ত্রণমূলক যেসব আইন রয়েছে তা মহাকাশে ভারতীয় প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর জন্য অচল অবস্থা তৈরি করে রেখেছে। প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে বেসরকারি একটি স্যাটেলাইটের ডিজাইন, তৈরি, উৎক্ষেপণ ও পরিচালনা করা হচ্ছে; যা থেকে ভারতের শেখার আছে। এ শিল্পের প্রসার ঘটানোর জন্য আমাদেরও চেষ্টা করা উচিত।’

রকেটিয়ারসের এই সহ-প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ভারতে আমাদের অনেক দক্ষ শক্তি আছে। নিম্নমানের নীতিমালার কারণে আমরা যদি এই এখাতে সফল না হতে পারি; তাহলে এটি আমাদের জন্য লজ্জার। অনেক ছোট দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। এই দেশটি এখন মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট পাঠানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা করছে। এই নবায়নযোগ্য মহাকাশযানে স্থান পাবে আরো অনেক খেলোয়াড়। আগামী কয়েক দশকে এই শিল্পের অবাধ বিস্ফোরণ ঘটবে।

দিবাংশু পোদ্দার বলেন বলেন, ভীত অথবা চিন্তিত হওয়ার বদলে ভারতের উচিত আনন্দ করা এবং বাংলাদেশের কাছে থেকে শেখা। মহাকাশে আরো অবাধ ও স্পন্দনশীল পরিবেশ তৈরিতে মনোনিবেশ করতে হবে।

ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার (ইএসএ) স্টার্ট আপ স্যাটরিসার্চের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, ফ্রান্স মহাকাশ সংস্থা ও জার্মান মহাকাশ কেন্দ্রের কর্মী নারায়ণ প্রসাদ বলেন, ‘২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের যে ভিশন দেশটির সরকার হাতে নিয়েছে বঙ্গবন্ধু-১ সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার একটি সফল পদক্ষেপ। বিনিয়োগের পেছনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদশে টেলিভিশন চ্যানেলের সেবা প্রদানে বিদেশি ট্রান্সপন্ডারের উপর নির্ভরতা থেকে সরে আসা।

‘যদিও ফরাসী প্রযুক্তি কোম্পানি থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসকে এটি তৈরির জন্য ২৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে বাংলাদেশ, এটি বিদেশি স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার ব্যাবহার এড়িয়ে লাভবান হবে। দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এই অঞ্চলের চাহিদা পূরণে ট্রান্সপন্ডার ভাড়াও দিতে পারবে। নিজস্ব স্যাটেলাইটে যথেষ্ট ট্রান্সপন্ডার সক্ষমতা না থাকায় ভারতও বিদেশি স্যাটেলােইটের ট্রান্সপন্ডার ভাড়ায় ব্যবহার করছে।’

মহাকাশভিত্তিক সক্ষমতার উপকারী ব্যবহারে আঞ্চলিক বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশিকে স্বাগত জানানো উচিত ভারতের। কারণ তাদের কাছে থেকে সমুদ্র ও ভূপ্রাকৃতিক তথ্যসহ বিভিন্ন তথ্য পেতে পারে ভারত।

অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নিউক্লিয়ার অ্যান্ড স্পেস পলিসি ইনিশিয়েটিভের জুনিয়র ফেলো বিদ্যা সাগর রেড্ডি বলেন, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করায় সাধুবাদ পাওয়া যোগ্য বাংলাদেশ। একই সময়ে এটি ভারতের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ায় মহাকাশ সেবার ব্যবহার এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ট্রেন্ড হয়েছে। ভারত সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের আগে ২০১৫ সালে ফ্রান্সের একটি কোম্পানির সঙ্গে স্যাটেলাইট নির্মাণ চুক্তি করে বাংলাদেশ।

‘সেই সময় ভারত বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণে সহায়তার প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের প্রথম এই স্যাটেলাইটের ওজন তিন হাজার ৫০০ কেজি; যা ভারতের উৎক্ষেপণ সক্ষমতার বাইরে। নির্ভরযোগ্য লাঞ্চারের অভাবে বাংলাদেশের উচু স্তরের একটি ব্যবসায়ীক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায় ভারতের। স্যাটেলাইটের এই প্রকল্পে ফ্রান্সের কাছে থেকে ২৫০ মিলিয়ন ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ।’

বিদ্যা সাগর রেড্ডি বলেন বলেন, ‘স্যাটেলাইটের স্পেকট্রাম ভাড়ার দেয়ার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ। এছাড়া শ্রীলঙ্কান কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। কিন্তু দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য ভারত এখনো বিদেশি স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীল। ভারত এখন নিজের ঘরের পাশেই স্যাটেলাইট সেবার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছে।’

‘ভারত এই নৌকা মিস করেছে, কিন্তু প্রতিবেশিরা যাতে আরো বেশি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে পারে এখন সেই প্রত্যাশা করা উচিত।’