বাণিজ্যের নতুন দ্বার খুলবে পদ্মা রেলসেতু

সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলওয়ে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। আরামদায়ক, সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও স্বল্প খরচে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে বাংলাদেশ রেলওয়ের কোনো বিকল্প নাই। বর্তমান রেলবান্ধব সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন রেল লাইন নির্মাণ, পুরাতন রেলপথ পুনর্বাসন, মিটার/ব্রড গেজ লাইনকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর, লোকোমোটিভ, যাত্রীবাহী কোচ ও মালবাহী ওয়াগন সংগ্রহ ও পুনর্বাসন, সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, নতুন ট্রেন সার্ভিস চালুসহ বেশ কিছু উদ্যোগ রেলওয়েকে অধিকতর নির্ভরযোগ্য আসনে বসিয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় রিলিফ, খাদ্য ও বস্ত্র পরিবহণ করে জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে থাকে। ঝড়-ঝঞ্চা, কুয়াশা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ রেল চলাচলে কখনো বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি। নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে রেলপথের গুরুত্ব অপরিসীম।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের সেতুবন্ধনে তৈরি হয়েছে নতুন মাত্রা। দ্রুত যাতায়াতের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সুযোগ। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পর্যটন ও শিল্পায়ণে যে আকাশচুম্বী সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তার প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন পরিকল্পনার সমন্বিত রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের ওই অঞ্চলে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, একইস্থান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অপূর্ব মনোরম সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, খানজাহান আলীর মাজার ও ষাটগম্বুজ মসজিদসহ অনেক দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন স্পট রয়েছে, যা এতদিন উত্তাল পদ্মানদী পেরিয়ে যাতায়াতের অসুবিধার কারণে জমে ওঠেনি। পদ্মাসেতুর মেলবন্ধন দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিতে যেমন নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, একইভাবে সেখানে শিল্পায়ণে নতুন নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি পর্যটন খাতেও অপার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে। এ সব কিছুকে বিবেচনায় নিয়ে সরকার পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৪ অক্টোবর, ২০১৮ পদ্মা সেতু রেল সংযোগ নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রেলওয়ের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা দিয়ে যশোরের সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক যুক্ত হবে। একই সঙ্গে ভাঙ্গা থেকে পাচুরিয়া-রাজবাড়ী সেকশনটি পদ্মা সেতু হয়ে সরাসরি ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে।

ট্রেনে ঢাকা থেকে খুলনার দূরত্ব এখন ৩৮১ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু দিয়ে যে নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে ঢাকা-খুলনার দূরত্ব হবে ২১২ কিলোমিটার। ১১ ঘন্টার বদলে চার ঘন্টাতেই যাওয়া যাবে খুলনা। কমবে পণ্য পরিবহণের খরচও। এমন নানামুখী সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে। ঢাকা থেকে পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে এখন ট্রেন যায় বঙ্গবন্ধু সেতু ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়ে। পদ্মা সেতুতে রেল চালু হলে ট্রেনগুলোকে এতোটা ঘুরে গন্তব্যে যেতে হবে না। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেললাইন আগামী সেপ্টেম্বরে চালু হবে। ফরিদপুর ও রাজবাড়ীর রেলসংযোগ আগে থেকেই আছে। ফলে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথের কাজ শেষ হলে পশ্চিমাঞ্চলের সাথে বিকল্প আরেকটি পথ চালু হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান ভাঙ্গা- পাচুরিয়া রাজবাড়ী সেকশনটি পদ্মা সেতু হয়ে রাজধানী ঢাকার সাথে সরাসরি সংযুক্ত হবে। এটি বাংলাদেশে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আরেকটি সাব-রুট স্থাপন এবং জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মালবাহী এবং বিজি কনটেইনার ট্রেন পরিষেবা চালু করবে। এই রুটটি কনটেইনার পরিবহণের ক্ষেত্রে গতি এবং লোড সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হবে।ফলে এই রেল চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে বড়ো ধরনের চমক দেখা যাবে।

পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পটি জি-টু-জি ভিত্তিতে বাংলাদেশ চীন যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পটির মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয়ের ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১০ লাখ টাকা বহন করছে বাংলাদেশ সরকার। আর ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা দেবে চীন। সে লক্ষ্যে চীনা এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ২৭ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন। আর সার্বিক তদারকি ও পরামর্শক হিসাবে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কন্সট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্টের (সিএসসি)। তাদের কাজে এবং সহযোগিতা করছে বিআরটিসি ও বুয়েট। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য গণ-পরিবহণ সুবিধা প্রবর্তনের মাধ্যমে আঞ্চলিক সমতা আনয়ন ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা। এতে মোট দেশীয় উৎপাদন (জিডিপি) আনুমানিক এক (১) শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মেইন লাইন ১৬৯.০০ কিঃমিঃ, লুপ ও সাইডিং ৪৩.২২ কিঃ মিঃ এবং ডাবল লাইন ৩.০০ কিঃ মিঃ সহ মোট ২১৫.২২ কিঃমিঃ রেলওয়ে ট্র্যাক নির্মাণ। ২৩.৩৭৭ কিঃমিঃ ভায়াডাক্ট,১.৯৮ কিঃ মিঃ র‌্যামস, ৫৯ টি মেজর ব্রিজ, ২৭২ টি মাইনর ব্রিজ (কালভার্ট/আন্ডারপাস), ২৯ টি লেভেল ক্রসিং নির্মাণ। ১৪ টি নতুন স্টেশন নির্মাণ এবং ৬ টি বিদ্যমান স্টেশনের উন্নয়ন ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ। ২০ টি স্টেশনে টেলিযোগাযোগসহ CBI সিস্টেম সিগন্যালিং ব্যবস্থা স্থাপন, ১০০ টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহ এবং ২৪২৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ। এ প্রকল্পের কাজ তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, ঢাকা থেকে মাওয়া, মাওয়া থেক ফরিদপুরের ভাঙ্গা এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর। ঢাকা-মাওয়া অংশের কাজের অগ্রগতি ৭৩ শতাংশ, মাওয়া-ভাঙ্গা অংশে ৯১ শতাংশ, ভাঙ্গা-যশোর অংশে ৬৮ শতাংশেরও বেশি কাজ হয়েছে। ১০০টি যাত্রীবাহী কোচের মধ্যে ইতিমধ্যে ৪৫টি সংগ্রহ করা হয়েছে।

বর্তমানে দেশের ৪৩টি জেলা রেলযোগাযোগের আওতায় আছে। ২০৩৫ সালে সরকার ৬৪ জেলায় রেলপথ সম্প্রসারণের মহাপরিকল্পনা করেছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঢাকা-যশোর পদ্মা সেতু রেললিংক প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বরিশাল বিভাগের পুরোটাই রেলযোগাযোগের আওতার বাইরে। সরকার এই বিভাগকে রেলের আওতায় আনতে পায়রা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল সংযোগ করতে চায়। ঢাকা-যশোর রেললাইন হলে এই কাজ সহজ হয়ে যাবে। ২০২৪ সালের মধ্যেই পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে রেল চলাচল শুরু হবে। এই রেলপথ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করবে। যার ফলে কলকাতা থেকে ঢাকা যাতায়াত অনেক সহজ হয়ে যাবে। আন্ত:দেশীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারতীয় রেলওয়ের সাথে বাংলাদেশ রেলওয়ের সংযোগের জন্য মোট ৮টি ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট রয়েছে। বর্তমানে ৫টি ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট চালু রয়েছে। বাকি ৩টি পয়েন্টের মধ্যে ১টি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দর্শনা-গেঁদে ও বেনাপোল-পেট্রাপোল সেকশন ট্রান্স-এশিয়া নেটওয়ার্কের অংশ। দর্শনা-গেঁদে, বেনাপোল-পেট্রাপোল এবং চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সংযোগ দিয়ে পণ্য ও আন্ত:দেশীয় যাত্রীবাহী ট্রেন যথাক্রমে মৈত্রী এক্সপ্রেস, বন্ধন এক্সপ্রেস এবং মিতালী এক্সপ্রেস চলাচল করছে। রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ ও বিরল -রাধিকাপুর রেল সংযোগের মাধ্যমে শুধু পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করছে। বর্তমানে ঢাকা থেকে কলকাতা টার্মিনাল স্টেশনের দূরত্ব ৫৩৩ কিলোমিটার। নদিয়া সীমান্ত হয়ে ঢাকা যেতে সময় লাগে ১১ ঘণ্টা। আর ঢাকা-যশোর হয়ে দু’দেশের মধ্যে ট্রেন চলাচল শুরু হলে-কলকাতা টার্মিনাল স্টেশন থেকে পেট্রাপোল,যশোর হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা পৌঁছবে মাত্র ৩ ঘণ্টায়। এতে দু’দেশই লাভবান হবে।

রেল চালু হলে দক্ষিণের ২১টি জেলার কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোটো ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবে। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবে তাদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। দক্ষিণাঞ্চলের সামগ্রিক উৎপাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প-বাণিজ্যেও বিনিয়োগ বেড়বে। সেই সাথে বাড়বে কর্মসংস্থান। ২১ জেলায় মানুষের আয়-রোজগার ও জীবনের মান বাড়ার প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে পড়বে।

ট্রেন একটি পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ, আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী গণ-পরিবহণ। শিশু, নারী, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী ও অসুস্থদের দূরবর্তী যাতায়াতসহ যাত্রী ও মালামাল পরিবহণে বিশ্বব্যাপী ট্রেনের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বল্প খরচে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে রেলওয়ের কোনো বিকল্প নাই। দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রান্তিক চাষিদের উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু বাজরজাতকরণ, উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণ স্বল্পসময়ে বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানো, দেশব্যাপী দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা ইত্যাদিতে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে। ভারসাম্যপূর্ণ যাতায়াত ব্যবস্থা বিনির্মাণে বর্তমান সরকার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় রেলের উন্নয়নে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। চলমান প্রকল্পসমূহের আওতায় নতুন রেলপথ নির্মাণ, বিদ্যমান রেলপথ সংস্কার, কমিউটার ট্রেন, লোকোমোটিভ ও ওয়াগন সংগ্রহ, নতুন নতুন ট্রেন চালু করা, পার্টস ও মেশিনারি সংগ্রহ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্ধারিত ৪ টি গোলের আওতায় ৮ টি টার্গেট বাস্তবায়নে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ সকল কার্যক্রম রেল পরিবহণ সেবার মানোন্নয়ন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রেল যোগাযোগ নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার সমুন্নত ও নিশ্চয়তা প্রদান করতে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে রেলওয়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।