বান্দরবানে কেএনএফের ‘প্রধান সমন্বয়ক’ গ্রেপ্তার
বান্দরবানে ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে শতাধিক সশস্ত্র সদস্য নিয়ে তিনটি ব্যাংক শাখায় হামলা, অর্থলুট ও অপহরণের মাধ্যমে ‘নিজেদের সক্ষমতা জানান দেওয়ার’ পর কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফের এক সদস্যকে তার বাড়ি থেকেই গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
৫৫ বছরের চেউসিম বমকে সংগঠনটির ‘প্রধান সমন্বয়ক’ এবং প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর র্যাব জানায়, শনিবার রাতে সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়াডের্র শ্যারন পাড়া থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তার কাছ থেকে দুটি এয়ারগান উদ্ধার করা হয়েছে।
বিকাল সাড়ে ৩টায় জেলা পরিষদের অডিটোরিয়ামে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “চেউসিমের বাড়িটি একতলা বিল্ডিং। বাড়িতে আমরা প্রবেশের চেষ্টা করি। কিন্তু পরে কোনোভাবে প্রবেশ করতে পারি। পরিবারের সদস্যরা আমাদেরকে কোনোভাবেই সহযোগিতা করছিল না। খোঁজার পরে তাকে না পেয়ে আরও অন্যান্য জায়গায় খোঁজার চেষ্টা করি। পরে বাড়ির ভেতরে একটি স্টিল স্ট্রাকচার (স্টিলের সিন্দুকের মত) ভেঙে তাকে বের করে নিয়ে আসি।”
শ্যারন পাড়াটি সুয়ালক ইউনিয়নে পড়লেও এর অবস্থান মূলত বান্দরবান-চিম্বুক সড়কের পাশে; যার দূরত্ব জেলা সদর থেকে আনুমানিক ৮-৯ কিলোমিটার হবে।
মঙ্গলবার রাতে এবং বুধবার দুপুরে বান্দরবানের রুমা এবং থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র লোকজন।
তারা টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে, একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। টাকার পাশাপাশি লুট করে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি।
রুমায় সোনালী ব্যাংকে হামলা-ডাকাতি এবং ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে অপহরণের ঘটনাটি মঙ্গলবার রাতে প্রথম ভাগে ঘটলেও; থানচিতে কৃষি ও সোনালী ব্যাংকে হামলা হয়েছে বুধবার ভরদুপুরে।
দুটি ঘটনাতেই পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ এর নাম এসেছে; যারা পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত। এরই মধ্যে ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করেছে র্যাব। এ ছাড়া এ দুটি ঘটনায় মোট ছয়টি মামলা হয়েছে।
শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বান্দরবান পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের জানান, কেএনএফের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী সামরিক বাহিনীর প্রধানকে নির্দেশনা দিয়েছেন।
এর মধ্যেই চেউসিম বমকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানাল র্যাব। তার সম্পর্কে র্যাবের ভাষ্য হচ্ছে, “কেএনএফের একেবারে প্রতিষ্ঠাতার প্রথম দিকে প্রধান সমন্বয়ক ও প্রধান উপদেষ্টা এবং কিছুদিন আগে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে তার অন্যতম পরামর্শক।”
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব অধিনায়ক বলেন, “পার্বত্য এলাকায় ছয়টি নৃগোষ্ঠী নিয়ে ২০১৪-১৫ সালের দিকে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি সামাজিক সংগঠন করা হয়। তিনি ওই সংগঠনের একজন প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে এনজিও থেকে কেএনএফ প্রতিষ্ঠা করে। চেউসিম বমের সঙ্গে নাথাম বমের ঘনিষ্ট সর্ম্পক রয়েছে। নাথাম প্রায় সময় তার বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন।
চেউসিমকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র্যাব দাবি করেছে, “জঙ্গি সংগঠন আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে ও তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা এই পরামর্শও দিয়েছেন চেউসিম। তার বাড়িতে বসে এই পরিকল্পনা করা হয়।
“এ ছাড়া কুকি-চিনের অন্যান্য সদস্যরা বান্দরবানে যখন আসে তখন চেউসিম বম তার বাড়িতে ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে রাখতেন। কিছুদিন আগে যে রুমা-থানচিতে ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনার আগে কিছু সদস্য তার বাসায় এসেছিল। হয়ত তার বাসায় থেকেই পরামর্শ ও পরিকল্পনা নিয়ে গিয়েছিল।”
কেএনএফের কার্যক্রম ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এবং তারা ‘অপরাধ, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি’ এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল দাবি করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “যার ফলে সাধারণ মানুষের কাছে কেএনএফ একটা আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়ায়।”
তিনি বলেন, “পাহাড়ে শান্তি বজায় রাখতে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়। এই শান্তি কমিটির কার্যক্রমকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুনরায় ন্যাক্কারজনক ব্যাংকে হামলা, ডাকাতি এবং ম্যানেজারকে অপহরণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা যে নিদর্শন-প্রদর্শন করেছে, তা আমাদের শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে কোনোভাবেই কাম্য নয়।”
ঘটনার পর বান্দরবানে র্যাবের কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা বিশেষ করে পুলিশ, বিজিবি এবং গোয়েন্দা সংস্থা সাহায্য করছে। ঢাকা ও কক্সবাজার থেকে র্যাবের অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব-১৫ অধিনায়ক বলেন, “নাথান বম কোথায় আছেন তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে না আসা পর্যন্ত এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে এই সশস্ত্র সংগঠনের অস্তিস্ত প্রকাশ্যে আসে ২০২২ সালের শুরুর দিকে। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও ম্রোদের নিয়ে এ সংগঠন গঠন করার কথা বলা হলেও সেখানে বম জনগোষ্ঠীর কিছু লোক রয়েছে। সে কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়।
কেএনএফ বলছে, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ নয়টি উপজেলা নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ গঠন করতে চায় তারা।
সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে ২০২২ সালে খবর দেয় র্যাব।
কেএনএফের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে পাহাড়ে আতংক ছড়িয়ে পড়লে ২০২৩ সালের ৩০ মে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। ওই বছরের জুলাই ও অগাস্টে কমিটির সঙ্গে কেএনএফের দুইবার ভার্চুয়াল আলোচনাও হয়।
পরে ৫ নভেম্বর রুমা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুনলাই পাড়ায় প্রথমবারের মত কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সরাসরি দুটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রথমবারের মত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
‘শান্তি আলোচনা’ শুরুর পর পাহাড়ে হত্যা-সহিংসতা থেকে মুক্তির আশা জাগতে শুরু করেছিল পাহাড়ের মানুষের মনে। এরইমধ্যে ২ ও ৩ এপ্রিল বান্দরবানের রুমা এবং থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র লোকজন।
তারা ব্যাংক থেকে টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে এবং এক ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। লুট করে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি।
দুটি ঘটনাতেই কেএনএফ এর নাম আসার পর ৪ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয় সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া আর ‘সম্ভব নয়’।
এরমধ্যে শনিবার রুমা ও বান্দরবান পরিদর্শন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “কোনো অবস্থায় পার্বত্য এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হতে দেওয়া যাবে না। যেকোনো মূল্যে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।”
পরদিন রোববার হেলিকপ্টারে বান্দরবানে এসে রুমা ও থানচির পরিস্থিত ঘুরে দেখেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, “আমরা এখন সরকারের ওভারঅল স্ট্র্যাটেজি, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে যেভাবে এটা সরকার চিন্তা করেছে, বাংলাদেশ সরকারের সমন্ত অর্গান, আমাদের সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, এবং অন্যান্য ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন, সব সমন্বিতভাবে আমরা এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করব।
“বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে দায়িত্বগুলো পালন করার, বিশেষ করে যৌথ অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া, সেইগুলো আমরা অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে করতে পারব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।”
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন