বিলেতে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের হারিয়ে যাওয়া যুগ

শুরুটা হয়েছিল ১৮১০ সালে। ব্রিটেনে প্রথম কারি হাউস বা বাংলাদেশি খাবারের দোকান।

শেখ দীন মোহাম্মদ তা শুরু করেছিলেন সেন্ট্রাল লন্ডনে পোর্টম্যান স্কোয়ারের কাছে জর্জ স্ট্রিটে। নাম রেখেছিলেন ‘হিন্দুস্তানী কফি হাউস’। সেখানে ভারত ফেরত ব্রিটিশদের জন্য তিনি বাংলার রান্না চালু করেছিলেন। খাঁটি ভারতীয় আমেজ সৃষ্টির জন্য হুকোয় ‘ছিলিম’ তামাক সেবনের ব্যবস্থাও করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ব্যবসা সফল হয়নি। একসময়ে দীন মোহাম্মদ দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন।
বাঙালিদের এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসার ইতিহাস তুলে ধরতে ব্রিটেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্মিংহামের মিউজিয়ামে শুরু হয়েছে এক প্রদর্শনী। খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ আলী, দেয়ালচিত্রের জন্য দেশে বিদেশে যার খ্যাতি, তিনি এই প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা।

মোহাম্মদ আলী বলছিলেন কেন এই প্রদর্শনী করছেন তার গল্প।

তাঁর বাবাও রেস্টুরেন্ট মালিক ছিলেন। পারিবারিক রেস্টুরেন্ট ‘রাজপুত’-এ নিজেও ছোটবেলায় ওয়েটারের কাজ করেছেন।
যেদিন খদ্দের কম থাকতো সেদিন ১৬ নম্বর টেবিলে বসে, যেটা মালিকের টেবিল হিসেবে ব্যবহার হতো, বাবার কাছে শুনতেন তাঁর জীবন সংগ্রামের কাহিনী।

লেখাপড়া করে গ্রাফিক শিল্পী ও কম্পিঊটার গেমস নির্মাতা হওয়ায় রেস্টুরেন্টের সঙ্গে মোহাম্মদ আলীর সম্পর্কে ছেদ পড়ে। কয়েক বছর আগে বাবার মৃত্যু হলে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার প্রতি তাঁর আগ্রহ ফিরে আসে। তবে তা ভিন্নরূপে। বাবার স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার ধারণা থেকে তাঁর মত আরও অনেক বাংলাদেশি কারি হাউসের ইতিহাস ধরে রাখার জন্য কিছু একটা করার কথা ভাবছিলেন, বলছিলেন মি: আলী।

ঢাকায় ব্রিটিশ কাউন্সিলের ‘লন্ডন ৭১’ প্রদর্শনীতে কাজ করার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন মি: আলী। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ব্রিটেন তথা বার্মিংহামে বাংলাদেশিদের কার্যক্রমের ছবি দেখতে দেখতে এই প্রদর্শনীর পরিকল্পনা তাঁর মাথায় আসে। সেখানেই জানলেন রজার গুয়েন নামে একজন ব্রিটিশ নাগরিকের কথা। যিনি বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে কাজ করতে যেয়ে বাংলাদেশকেই ভালবেসে ফেলেছেন। শিক্ষকতা করতেন বলে বাংলাদেশিদের মধ্যে যার পরিচিতি রজার মাস্টার নামে। ব্রিটেনে ফিরে এসে মোহাম্মদ আলী রজার মাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।

কথা হচ্ছিল রজার মাস্টারের সঙ্গে। তিনি আমাকে বলছিলেন কিভাবে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ।

“প্রদর্শনীর পরিকল্পনা যখন চলছিল, মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে তখন আমার পরিচয় হয়। আমি তাঁকে বললাম আমিও বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে কাজ করেছি। আমার কাছে কিছু ডায়েরি, রেস্টুরেন্টের তালিকা, কিছু ছবি ছিল। তাতে আলী খুব অবাক হয় এবং খুশিও হয়। উৎসাহও পায় যে বেশ কিছু জিনিস হয়তো পাওয়া যাবে। আমার কাছে যা ছিল সেগুলো তাঁকে দেই এবং আরও কিছু যাদের কাছে পাওয়া যেতে পারে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেই”।

মোহাম্মদ আলীর কাজ তখন প্রত্নতাত্বিকের মত বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের উপর তলায়, নীচ তলায়, ভাড়ার ঘরে যেয়ে ধুলোর আস্তর ঢাকা কাগজপত্রের ভিতর থেকে সংরক্ষণের উপযোগী জিনিস খুঁজে বের করা।

আলী বলেন, “আমি জানতাম আমি কী খুঁজছি – যা অনেকের কাছেই ছিল মূল্যহীন। আবার অনেককে বোঝাতে হয়েছে নিজেরা কোথা থেকে কেমন করে এসেছেন, বংশধররা যাতে ৫০ বা ১০০ বছর পরেও তাদের শিকড় সম্বন্ধে জানতে পারে, সেজন্যই আপনাদের সাহায্য চাই। আমার বাবা ওয়াতির আলীর – পরিচয় দেওয়াতেও অনেকে এগিয়ে এসেছেন ‘হেতো আমরার পোয়া, হেরে আমরা সাহাইয্য না করলা কে করতো’ বলে”।
প্রদর্শনীর ছবিগুলো এবং অন্যান্য সংগ্রহ দেখে কারি হাউসের মালিক কর্মচারীদের তখনকার জীবন এবং গ্রাহক কারা ছিলেন, কেমন ছিল পরিবেশ, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।

রজার মাস্টার বললেন, “আমি প্রথমে কাজ করতাম ‘রাজভোজ’-এ, তারপর ‘কারি কিং’ এবং শেষে ‘লাইট অব বেঙ্গল’ রেস্টুরেন্টে। তিনটিই বার্মিংহামের সেলি ওক এলাকায় ছিল। রাজভোজের মালিক ছিল দেওয়ান আলম নুর রাজা, কারি কিং-এর মালিক ছিল ফখরুদ্দিন বা ফখর মিয়া, লাইট অব বেঙ্গলের মালিক ছিলেন আবদুল জব্বর মোহাব্বত মিয়া। এদের মধ্যে ফখর মিয়া বেঁচে আছেন। তাঁরা আমার সাথে অমায়িক ব্যবহার করতেন। তাঁরা অনেক বড়লোক, ব্যবসার মালিক ছিলেন কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোন দেমাগ ছিলনা। তাঁদের সাথে অনেক মজার সময় কাটিয়েছি”।

বার্মিংহামে প্রথম কারি হাউস জন’স রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করে ১৯৪৫ সালে। মালিক ছিলেন এম এ আজিজ। ১৯৬৩ সালে সেলি ওকে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দি অজন্তা’ – রানা কান্ত দে, গোলাম হোসেন আর জয়েন উল্লাহ্‌ এই তিন জনের অংশীদারিত্বে। মালিকদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে রামা কান্ত দে বলেন, “আমরা যখন ব্যবসা শুরু করি তখন অনেক কষ্ট করেছি। কিন্তু তখন এই ব্যবসাটা খুব অভিজাত ব্যবসা ছিল। রেস্টুরেন্ট মালিকদের দেখলে সবাই ভাবতেন তিনি নিশ্চয়ই বিশিষ্ট একজন”।

প্রদর্শনীতে রয়েছে কারি হাউসগুলো সাজানোর উপকরণ ও ছবি। মুঘল বা রাজস্থানী চিত্রকলার অনুকরণে আঁকা রমণীর ছবিতেও মালিকদের প্রকট দেশের টান প্রকাশ হতো পটভূমিতে সিলেটের চা বাগান বা ধানক্ষেতের দৃশ্যে। গাঢ় উজ্জল রংয়ের ওয়াল পেপারে দেয়াল সজ্জা ছিল আরেক বৈশিষ্ট। খদ্দের আকর্ষণের জন্য ‘বার্মিংহাম প্লানেট’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের ছবিও রয়েছে। একটির প্রচারপত্রে বলা হয়েছে “লাস্যময়ী মেয়েরা পানীয় পরিবেশন করে”। বৃটিশ মেয়েরা কীভাবে বাংলাদেশিদের বিয়ে করে, তাদের ব্যবসায় এবং স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করেছেন তার ছবিও রয়েছে।

বাংলাদেশি কারি হাউসের প্রদর্শনী শুধু একটি ব্যবসা বা শিল্পের ইতিহাস নয়। এতে তখনকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনযাত্রাও ফুটে উঠেছে। যেমন ৬০/ ৬৫ বছর আগেও জন্মদিনের অনুষ্ঠান করার ছবি বা ইংরেজ অতিথিদের ছবি দেখে বোঝা যায় রেস্টুরেন্টগুলো স্থানীয় জীবনযাত্রার সাথে বেশ সম্পৃক্ত ছিল। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যেও রসবোধ তখনকার রেস্টুরেন্ট কর্মীরা হারিয়ে ফেলেননি। বাংলাদেশ থেকে আগতদের জন্যও এগুলো ছিল ভরসাস্থল।

প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন আবদুল হামিদ। তিনি বললেন, “১৯৭৮ সালে এদেশে আসি। আমার ভাই আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। রেস্টুরেন্টে কাজ করে, এস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ যুগিয়েছি”। তাঁর নিয়োগকারী তারকা নন্দের সঙ্গেও দেখা হলো প্রদর্শনীতে।

প্রদর্শনীটি বার্মিংহামের বাংলাদেশিদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। শহরের বাসিন্দা সিমি রহমান একটি ওয়েব টিভির উপস্থাপক। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, “এতে বাংলাদেশিদের সাফল্যের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। এটা বার্মিংহামের জীবন প্রবাহে আমাদের অবদানের প্রমাণ – যা আমাদের পরিচিতিও দিয়েছে”।

বাংলাদেশি কেবল টিভির কর্মী রিয়াদ আহাদ বলেন, “বাংলাদেশিদের জীবনযাত্রা নিয়ে এতবড় একটি সংগ্রহ ব্রিটেনের আর কোন জাদুঘরে আছে বলে আমার জানা নেই। হয়তো ১০০ বছর পর আমাদের কোন উত্তরপুরুষ এই সংগ্রহ দেখে গর্ব অনুভব করবে”।

মোহাম্মদ আলী এই প্রদর্শনীকে আগামী বছরের কোন এক সময় নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

তাঁর প্রতিষ্ঠান সউল সিটি আর্টস এই প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা। আর এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বার্মিংহাম মিউজিয়াম অ্যান্ড আর্ট গ্যালারি ও হেরিটেজ লটারি ফান্ড। প্রদর্শনীটি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে, চলবে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত।