বিশ্বজুড়ে ভারতীয়রা চাকরির শীর্ষপদে কেন?

বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে চাকরিসূত্রে বিপুল পরিমাণ বিদেশির অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আমাদের তরুণরা এখন মাত্র কয়েক হাজার সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছেন। অথচ একই সময়ে প্রচুর বিদেশি, মূলত ভারতীয়রা, এদেশে চাকরির মাধ্যমে তাদের দেশে শত শত কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সংসদে জানান, মোট ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি বাংলাদেশে বৈধভাবে কাজ করছেন। তার মধ্যে শীর্ষে ভারতীয়রা। যার সংখ্যা ৩৫ হাজার ৩৮৬ জন। এরপরে ১৩ হাজার ২৮৬ জন চাইনিজ নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করছেন। এছাড়া জাপানি, কোরিয়ান, মালয়েশিয়ান, শ্রীলঙ্কানরা রয়েছেন। গত মে মাসে একটি ইংরেজি জাতীয় পত্রিকা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে উদ্ধৃত করে জানায়, প্রতিবছর বিদেশিরা পাঁচশ’ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে তাদের দেশে পাঠান। অন্যদের তুলনায় ভারতীয়দের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদের দেশেই যে বেশিরভাগ অর্থ যাচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।

তবে এখানে আমি শুধু সরকারি হিসাব মতে বৈধভাবে যারা বাংলাদেশে কাজ করছেন, তাদের কথাই উল্লেখ করেছি। বেসরকারি হিসাব মতে, বাংলাদেশে অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা এবং তাদের দেশে পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। তা নিয়ে দেশের মিডিয়ায় নিয়মিত লেখালেখি হচ্ছে।

আমি নিজেও সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় ও ফেসবুকে বাংলাদেশি তরুণদের চাকরি সংকটের কারণ এবং শিক্ষার সঙ্গে চাকরিকে সম্পর্কিত করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখালেখি করেছি। তবে এখানে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ আলোচনা করতে চাই। যদিও ভারতীয়রা বাংলাদেশে গার্মেন্টস, আইটি, বায়িং হাউজসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পর্যায়ে উচ্চপদে কর্মরত বা টপ ম্যানেজমেন্টের অংশ, তবে অনেকেই হয়তো জানেন যে, তারা শুধু বাংলাদেশেই উচ্চপদে চাকরি করছেন, তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বহুজাতিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ বহুপাক্ষিক সংস্থার সিইও বা প্রধান নির্বাহীসহ বিভিন্ন উচ্চপদেও ভারতীয়দের জয়জয়কার। তাই আমাদের তো অন্তত জানা উচিত, কেন আমাদের তরুণরা দেশে-বিদেশে চাকরিতে পিছিয়ে অথচ ভারতীয়রা কেন এক্ষেত্রে সফল হচ্ছেন। এ অভিজ্ঞতা তো আমাদের তরুণদের চাকরিপ্রাপ্তিতে কাজে লাগাতে পারি।

মো. সামসুল ইসলাম

ভারতীয়দের প্রধান নির্বাহী বা এ রকম পদে চাকরিপ্রাপ্তির প্রবণতা শুরু হয়েছে কিন্তু বেশ আগে থেকেই। ২০১১ সালের আগস্টে টাইম পত্রিকায় India’s Leading Export: CEOs শীর্ষক এক মজাদার নিবন্ধে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে ভারতীয়দের প্রধান নির্বাহীদের তালিকার কারণগুলো অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়। এ সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এই মুহূর্তে বিশ্বখ্যাত কোম্পানিগুলোর ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিইও’র তালিকায় রয়েছেন—সুন্দর পিচাই, সিইও গুগল; সত্য নাদেলা, সিইও মাইক্রোসফট; অজয় পাল সিং বঙ্গ, প্রেসিডেন্ট এবং সিইও, মাস্টারকার্ড; রাজীব সুরি, সিইও, নোকিয়া; শান্তনু নারায়েন, সিইও, আডোবে সিস্টেমস; রাকেশ কাপুর, সিইও রেকিট বেংকিসার; জর্জ কুরিয়ান, সিইও, প্রেসিডেন্ট ও ডিরেক্টর নেটএপ; দীনেশ পালিওয়াল, প্রেসিডেন্ট ও সিইও, হারমান ইন্টারন্যাশনাল; সঞ্জয় মেহরোত্রা, সিইও, মাইক্রন টেকনোলজি; ইন্দ্রা নুইয়ি, চেয়ারম্যান ও সিইও, পেপসিকো; ফ্রান্সিস্কো ডি সুজা, সিইও, কগনিজ্যান্ট। এ তালিকা আরও দীর্ঘ ও বিস্ময়করই বটে। আর যারা ইতোমধ্যে তাদের মেয়াদ শেষ করেছেন বা পদত্যাগ করেছেন, তাদের তো এ তালিকায় অন্তর্ভুক্তই করা হয়নি।

শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলোতে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবস্থাপক হিসেবেও ভারতীয়রা শীর্ষে রয়েছেন। ফোর্বস মিডল ইস্টে দেখলাম আরব দেশগুলোতে ২০১৮ সালে বিভিন্ন জাতীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে সিইও, প্রেসিডেন্ট বা সমপর্যায়ের ৫০ জন ভারতীয়দের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এসব তালিকা যেকোনও ভারতীয়কেই গর্বিত করবে। এক্ষেত্রে তারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছেন।

তবে বিদেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিইওদের প্রশংসা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমরা দেখতে চাইছি ভারতীয়দের কী গুণ তাদের বিশ্বজুড়ে ব্যবস্থাপক হিসেবে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করছে, যার ফলে তারা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন?

তবে কেন যে ভারতীয়রা শীর্ষপদগুলো দখলে এগিয়ে তা নিয়েও আছে বিস্তর বিতর্ক। প্রথমেই যে বৈশিষ্ট্য ভারতীয় সিইওদের মধ্যে দেখা যায়, তা হলো তাদের বেশিরভাগই পশ্চিমা টপ র‍্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা। আবার অনেকেরেই রয়েছে আইটি বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোনও বিষয়ের সঙ্গে এমবিএর ডিগ্রির সমন্বয়। পড়াশোনার কারণে তারা যে চাকরির শীর্ষপদে যাচ্ছেন, তা হয়তো একটি অন্যতম কারণ। কারণ তারা পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালগুলোতে অধ্যাপনাতেও ভালো করছেন। যেমন নীতিন নোহরিইয়ার কথা বলা যায়। যিনি হার্ভাড বিজনেস স্কুলের বর্তমান ডিন।

ইংরেজিতে বিশেষ পারদর্শিতাসহ ভারতীয়দের যোগাযোগ দক্ষতার ব্যাপারে সবাই একমত। ইংরেজি ভাষায় ভারত যেমন এগিয়ে রয়েছে, তেমনি বিশাল ও বহুসংস্কৃতির দেশ হিসেবে তাদের আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগে বেশ দক্ষতা রয়েছে। এমনকী চাইনিজরাও স্বীকার করেন যে, তারা এ বিষয়ে ভারতীয়দের চেয়ে পেছনে পড়ে রয়েছেন। ভারতীয়রা সহজেই পশ্চিমাদের বা অন্য সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন। বৈচিত্র্য তো ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ। ভারতীয় ব্যবস্থাপকরা বলেন, আমরা যখন একটা ওয়েবসাইট বানাই, তখন বুঝি এটি বহু ভাষার হতে হবে। একক সংস্কৃতির কারণে যেটা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার লোকজন করে না।

এক চাইনিজ লেখক ভারতীয়দের ব্যবস্থাপনায় সফলতার এক ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলছেন, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতীয়দের জটিল অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে (যেমন ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, ভাষা ও ধর্ম) ভয়াবহ ব্যবস্থাপনার সংকট দেখা যায়, যার ফলে তারা ব্যবস্থাপনার দিকে অতিমাত্রায় মনোযোগী হন। তারা এখন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে পেশাগত জ্ঞানের সমন্বয় ঘটাচ্ছেন এবং এর ফলে ভালো করছেন।

এছাড়া বিরূপ পরিস্থিতিতে, স্বল্প বাজেটে কাজ করতে অভ্যস্ত ভারতীয়রা। বিশেষজ্ঞদের মতে তারা ‘বাইফোকাল এপ্রোচে’ কাজ করেন অর্থাৎ একই সঙ্গে তারা প্রতিদিনের আয় থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যান। কোম্পানির লাভের দিকে তাদের থাকে সতর্ক দৃষ্টি। ব্যবসায়ের সব দিকেই তারা খেয়াল রাখেন। তারা প্রকৃত অর্থেই একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে পারেন।

যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি ব্যবসায়ী নই, পেশাগতভাবে আমি এ পর্যন্ত গবেষণা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে এসেছি, তবু ভারতীয়দের সঙ্গে সাম্প্রতিক একটি ব্যবসায়িক আলোচনার অভিজ্ঞতায় আমি তাদের প্রফেশনালিজম সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছি। বেশ কয়েকমাস আগে এক বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি খ্যাতনামা ভারতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশে ফ্রাঞ্চাইজ বা বিজনেস পার্টনার চেয়ে পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। যেহেতু শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসা তাই আমি আগ্রহ প্রকাশ করে আমার সিভি পাঠিয়ে দেই। সঙ্গে সঙ্গেই তারা আমাকে ইমেইলে উত্তর দিলো। একদিন ফোন করে দীর্ঘক্ষণ কথা বললো। যেহেতু তারা প্রথমে একটি মাত্র অফিস খুলবে, এবং অর্থ বিনিয়োগের ব্যাপার ছিল, যা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই পরবর্তী সময়ে আমি তাদের না করে দেই। তারপরও তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে বলেছিল।

এক্ষেত্রে আমার যেটা ভালো লেগেছে, তাহলো তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। আমার টাকা-পয়সা বা ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা নেই দেখেও তারা প্রথমেই আমাকে বাতিল করে দেয়নি। আমাকে কীভাবে ব্যবসায়ে কাজে লাগানো যায়, সেটা নিয়ে তারা চিন্তা করেছে। অথচ আমাদের দেশে আমি এ বছর যখন শিক্ষকতা ছেড়ে ব্যবসা করতে চেয়েছি, তখন সহযোগিতা দূরের কথা, সবার কাছে মোটামুটি পাগল আখ্যা পেয়েছি। তাই এখন গবেষণা বা লেখালখি নিয়েই আছি।

আগেই বলেছি, আমার এই লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমাদের তরুণরা দেশে বিদেশে কীভাবে আরও বেশি চাকরি পেতে পারেন বা শীর্ষপদে যেতে পারেন, সে ব্যাপারে নিজেদের জ্ঞান সমৃদ্ধ করা। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পত্রিকায় দেখি মধ্যপ্রাচ্যেও বাংলাদেশিদের বেতন ভারতীয়দের চেয়ে অনেক কম। আমাদের তরুণ-তরুণীরা কিন্তু কম মেধাবী নন। সংখ্যায় অল্প হলেও তাদের অনেকেই বিদেশে ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত। আমরা যদি বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের সন্তানদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করতে পারি, তাহলে দেশে-বিদেশে তাদের জন্য আরও কর্মসস্থান সৃষ্টি হতে পারে। তারা আমাদের জন্য বয়ে আনতে পারেন আরও সম্মান ও মর্যাদা।

লেখক : মো. সামসুল ইসলাম, গবেষক ও কলামিস্ট