বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব

যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্বজুড়ে। এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে। অনিশ্চয়তার কারণে বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে পতন ঘটছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধটি শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক যুদ্ধে মোড় নিতে যাচ্ছে। ইউক্রেনের ওপর হামলার জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশ রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এ ছাড়া আর্থিক লেনদেনের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকেও রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে সরিয়ে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ।

এর ফলে রাশিয়ান রুবলের দরপতন ঘটতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সুইফটের নিষেধাজ্ঞা জারি হলে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে অন্য দেশগুলো আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আর্থিক লেনদেন করতে পারবে না। তখন দ্বিপক্ষীয় লেনদেনে যেতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ। এতে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহজনিত সংকটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামেও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

ড. সালেহউদ্দিন বলেন, তুরস্ক কৃষ্ণসাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রপথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে ইংলিশ চ্যানেলে একটি রাশিয়ান জাহাজ আটক করেছে ফ্রান্স। জাহাজ চলাচল করতে না পারলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানিসহ খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলায় এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজাওে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৯৮ থেকে ১০২ ডলারের কাছাকাছি। এর আগে যুদ্ধ শুরুর দুই দিনের মধ্যে গত বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে ১০৫ ডলারে ওঠে, যা ছিল গত সাত বছরে সর্বোচ্চ। ২০১৪ সালের পর এত বেশি দামে বিক্রি হয়নি জ্বালানি তেল।
তেলের দামের পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজারেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। যুদ্ধ দির্ঘায়িত হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।

যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে সোনার বাজারেও। আন্তর্জাতিক বাজারে বৃহস্পতিবার সোনার দাম আউন্সপ্রতি (২৮ দশমিক ৪ গ্রাম) ২ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৯৬৮ ডলারে বিক্রি হয়েছে। যদিও পরদিন শুক্রবার স্পট মার্কেটে সোনার দাম প্রতি আউন্স ১ হাজার ৯০৯ ডলারে নেমে আসে। সাপ্তাহিক ছুটির পর আজ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও সোনার দর কোথায় যায় সেটিই এখন দেখার বিষয়।

যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে ভোগ্যপণ্যের বাজারেও। করোনা মহামারীর কারণে সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে এমনিতেই ঊর্ধ্বমুখী ছিল। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর আরেক দফা বেড়েছে পাম অয়েলের দাম। দ্য ইকোনমিক টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রতি টন ক্রুড পাম অয়েলের দাম ১ হাজার ২৬৭ ডলার থেকে বেড়ে ২৫ ফেব্রুয়ারি ১ হাজার ৩৪৪ ডলারে উঠে যায়। স্পট মার্কেটে টনপ্রতি দাম ছিল আরও বেশি- ১ হাজার ৩৯০ ডলার। যুদ্ধ শুরুর আগেই আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এবার যুদ্ধের কারণে এই খাদ্যপণ্যটির দাম আরেক দফা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। মানভেদে টনপ্রতি গমের দাম এরই মধ্যে ৪০০ ডলার থেকে বেড়ে ৫০০ ডলারে পৌঁছেছে। কানাডা থেকে আমদানি করা গমের দাম টনপ্রতি ৫০৫ ডলারে উঠেছে। ভারতীয় গমের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। এর ফলে আমদানিনির্ভর বাংলাদেশেও গমের দাম আরেক দফা বাড়তে পারে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়া, আজারবাইজান ও কাজাখস্তানের অপরিশোধিত তেলের ওপর নির্ভরশীল। এসব দেশ থেকে পরিশোধিত তেল জাহাজে করে কৃষ্ণসাগরের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিমে যায়। পশ্চিমে অবস্থিত দেশগুলো তাদের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে অপরিশোধিত তেলের জাহাজের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া এ অঞ্চলটি তার বন্দরগুলো থেকে বছরে কয়েক মিলিয়ন টন শস্য ও উদ্ভিজ্জ তেল সরবরাহ করে। ফলে কৃষ্ণসাগরে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটলে এটি শুধু ইউরোপ নয়, সারা বিশ্বেই জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করবে। আর এর সবচেয়ে বড় ভোগান্তির শিকার হবে এশিয়ার মানুষ।

ড. সালেহউদ্দিন বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের খাদ্যপণ্যের ওপর নির্ভরশীল ইউরোপ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের গম আমদানির প্রধান উৎস্যস্থল যুদ্ধরত দেশ দুটি। ফলে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব শুধু ইউরোপ নয়, এটি এশিয়া থেকে দূরপ্রাচ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে।