বিশ্বে শান্তি স্থাপনে শেখ হাসিনার চার প্রস্তাব

‘আরব ইসলামিক আমেরিকান সামিটে’ অংশ নিয়ে বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের সামনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরলেন বিশ্বে শান্তি স্থাপনে তার চারটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব। সেখানে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মুসলিম প্রধান অর্ধশতাধিক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান।

তাদের সামনে শেখ হাসিনা বললেন সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করতে হবে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্য অর্থায়ন বন্ধ করতে হবে, মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি দূর করতে হবে আর সংলাপের মধ্য দিয়ে আসবে বিশ্বশান্তি।

আরব-ইসলামিক-আমেরিকান সম্মেলন আয়োজন করেছে সৌদি আরব। আর সে অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য সোদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্ব ফোরামে বিশ্ব নেতার মতোই এসব প্রস্তাব তুলে ধরলেন শেখ হাসিনা।

কিং আবদুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে এই শীর্ষ সম্মলনে শেখ হাসিনা জানালেন, আরব-ইসলামিক-আমেরিকান সম্মেলনে সবার সাথে যোগ দিতে পেরে তিনি আনন্দিত। বললেন, কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি মহামান্য বাদশাহ সালমানকে, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি কর্মসূচিতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।

রিয়াদে যে সন্ত্রাস-বিরোধী ইসলামিক সেন্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাদশাহ সালমান নিয়েছেন তার জন্যও তাকে ধন্যবাদ জানালেন শেখ হাসিনা। বললেন, এই সেন্টারের প্রতিষ্টাতা সদস্য দেশ হতে পেরে আমরা আনন্দিত।

মূল বক্তৃতা শেখ হাসিনা শুরু করেন সন্ত্রাসবাদ আর সহিংস মৌলবাদ প্রসঙ্গ দিয়ে। তিনি বলেন এই সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদ আজ বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পথেই কেবল হুমকি বয়ে আনছে না, মানব সভ্যতাকেই বিপর্যস্ত করে তুলছে। এর বিস্তৃতির কুফল থেকে বিশ্বের কোনো দেশই রেহাই পাবেনা, কোন ধর্ম কিংবা কোন মতের মানুষই এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে পারবে না। এই চরম সত্য উপলব্দি থেকে বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধ জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। আমাদের সীমারেখা কিংবা আমাদের সম্পদ কোনও সন্ত্রাসের কর্মকাণ্ডে যাতে কেউ ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা দৃঢ় অবস্থানে রয়েছি।

আমাদের কাছে সন্ত্রাসীর আলাদা কোনও নাম নেই, যে সন্ত্রাসী সে সন্ত্রাসীই। ওদের কোনও ধর্ম নেই, নেই কোনো মত কিংবা জাতি, বিশ্ব ফোরামে এই দৃঢ় উচ্চারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, সহিংসতা, সন্ত্রাস আর হত্যার সমর্থন এই ধর্ম করে না। ধর্মের নামে কোনও ধরনের সহিংস মৌলবাদ আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

বিশ্ব ফোরামকে জানিয়ে দিলেন সন্ত্রাস মোকাবেলায় তার সরকারের অবস্থান ও কাজগুলোর কথা। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণভাবে বেড়ে ওঠা কিছু সহিংস মৌলবাদি শক্তিকে আমরা কার্যকরভাবে মোকাবেলা করছি। কিছু সংখ্যক সন্ত্রাসবাদী দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই অপশক্তিগুলো দেশের ভেতরেই কিছু স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সমর্থন পেয়ে আসছিলো, যা ধীরে ধীরে দমন করা হচ্ছে।

বিশ্ব নেতৃত্বকে শেখ হাসিনা আরও জানান, এই অপতৎপরতা দমনে বহুমুখী কৌশল নিয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সন্ত্রাস দমনে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে কার্যকর করে তোলা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মাঝেও জনমত গড়ে তোলা হচ্ছে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে বৈঠক করে, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মতবিনিময় করছি, বিশেষ করে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ছাত্র, মসজিদের ইমামদের সঙ্গে কথা বলছি, যাতে তাদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গি বাদের বিরুদ্ধে মতামত গড়ে তোলা যায়।

সন্ত্রাস ও সহিংস মৌলবাদীতার উত্থানে আজ বিশ্ব শরণার্থী সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। এর কার্যকর সমাধান প্রয়োজন। এসময় আবেগাপ্লুত কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, তিন বছরের শিশু আইলানের সমুদ্র তীরে মৃত পড়ে থাকার দৃশ্য কিংবা আলেপ্পোয় রক্তমাখা নিস্তব্দ শিশু ওমরান আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে গেছে। একজন মা হিসেবে বিশ্বের যেখানেই ঘটুক, এমন দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারি না।

শেখ হাসিনা আরো বলেন, একজন উদ্বাস্তুর কী বেদনা বা যন্ত্রণা তা আমি ভালো করেই বুঝি কিংবা জানি। কারণ আমি নিজেও একদিন উদ্বাস্তু ছিলাম।

বিশ্ব নেতৃত্ব আপনারা শুনুন, ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ ভোগান্তি আর অবহেলা আজ তরুণ প্রজন্মের কাছে এক অবিচার বলেই প্রতীয়মান। সুতরাং ফিলিস্তিনকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্শাল প্ল্যানকে সামনে রেখে ইরাক ও সিরিয়ার মতো যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোর পুনর্গঠনের আহবানও জানান শেখ হাসিনা।

সবশেষে শেখ হাসিনা গোটা কয় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন-

প্রথমত, আমাদের অবশ্যই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কাছে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত সন্ত্রাসী ও তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলোর প্রতি অর্থের যোগান বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত, ইসলামী উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি দুর করতে হবে। আর চতুর্থত, সংলাপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংকটগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বের করতে হবে যাতে সকল পক্ষই তাদের নিজ নিজ সাফল্যের দিকটি নিশ্চিত করতে পারে।

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের কিং আব্দুল আজিজ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে রবিবার এই সম্মেলন হয়। প্রধানমন্ত্রী সম্মেলন স্থলে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান সৌদি বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদ।

উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় নতুন অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা এবং নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা জোরদারের লক্ষ্যে আয়োজিত এই সম্মেলনে ইসলামি চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই লড়াইকে ‘সভ্যতার সংঘাতের’ বদলে ‘শুভ ও অশুভের যুদ্ধ’ বলেছেন তিনি।

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অন্য নেতাদের মধ্যে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি, কুয়েতের আমির সাবাহ আল-আহমাদ আল-সাবাহ ও বাহরাইনের বাদশা হামাদ বিন ইস আল-খলীফাসহ মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম প্রধান দেশগুলোর নেতারা রয়েছেন।
সৌদি বাদশার আমন্ত্রণে এই সম্মেলনে যোগ দেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান। সৌদি আরবের সাংস্কৃতিক ও তথ্যমন্ত্রী আওয়াদ বিন-সালেহ-আল-আওয়াদ গত ৯ মে ঢাকায় এসে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে এই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে যান।

সোমবার মহানবী (স.) এর রওজা জিয়ারত করতে মদিনায় যাবেন শেখ হাসিনা। একই দিন সন্ধ্যায় মদিনা থেকে ফিরে মক্কায় ওমরাহ পালন করবেন তিনি।

মঙ্গলবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে।