বেকারদের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হচ্ছে বাতাস | সাফাত জামিল শুভ

সাফাত জামিল শুভ : কেউ স্বীকার করছে না, তবে বাস্তবতা হল বিশ্বে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। আমাদের জীবনধারণ প্রনালী ও অর্থনীতি এখনও প্রধানত মৌলিক চাহিদা ভিত্তিক হবার কারণে আমরা এই মন্দার প্রভাব ভাল করে বুঝতে পারছি না। একদিকে বেকার সমস্যা অন্যদিকে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পাওয়ায় দিনের পর দিন হতাশাগ্রস্থ হচ্ছে তরুণরা।

বেকারত্ব হল কাজের অভাবে অনিচ্ছাকৃত কর্মহীনতা। বেকার বলতে শ্রমশক্তির সেই অংশকে বুঝানো হয়, যারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সন্ধান করা সত্ত্বেও কোন কাজ পায় না।বাংলাদেশের শ্রমশক্তি সম্পর্কিত জরিপে (২০০২-০৩ এবং ২০০৫-০৬) ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের এমন ব্যক্তিকে বেকার বিবেচনা করা হয়েছে যে সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করা বা কাজের জন্য প্রস্ত্তত থাকা সত্ত্বেও কোন কাজ করে নি। বাংলাদেশে বেকারত্বের এই সংজ্ঞা দৃশ্যমান ও অদৃশ্য আংশিক কর্মসংস্থান সম্পর্কিত ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উৎপাদনের অন্যান্য উপাদানের মধ্যকার মৌলিক ভারসাম্যহীনতাকে প্রতিফলিত করে।

গত ১ জুন বাজেট ঘোষণার পর থেকে বেকারের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য উদ্ধৃত করে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা সংসদে বলেন, দেশে এখন বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ। বাকিদের কাজের ব্যবস্থা হয়েছে। গত ২৮ জুন অর্থবিল পাসের আগে আলোচনায় অংশ নিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, দেশে ২৬ লাখ বেকার আছে বলে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে এটা সঠিক নয়। শুধু ঢাকা শহরেই বেকারের সংখ্যা হবে ২৬ লাখ।রওশন এরশাদ বলেন, প্রতিবছর লেখাপড়া শেষ করে ২৪-২৫ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। এরা সবাই চাকরি পায় না। তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য উদ্ধৃত করে বলেন, দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। এর মধ্যে ১০ কোটি মানুষ রয়েছে কর্মক্ষম। তার ভেতর পাঁচ কোটি মানুষ কাজ পেয়েছে। বাকি পাঁচ কোটি মানুষ কোনো কাজ পায় না।

যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। তারা কর্মের সংস্থান করতে পারে না।

দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্বল্প শিক্ষিতের পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষিত কর্মহীনের সংখ্যাও বাড়ছে। সেই সঙ্গে ছোট হয়ে আসছে কর্মসংস্থানের পরিধি। ইঞ্জিনিয়ারিং ও এমবিবিএস এর মতো সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে অনেক উচ্চ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী ঘুরছেন বেকারত্ব নিয়ে। দেশে স্বল্প শিক্ষিত ও মধ্যম শিক্ষিতের কর্মসংস্থানে যে সংকট, প্রায় তার অনুরূপ সংকট উচ্চ শিক্ষিতের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও। কারণ একটাই অর্থাৎ তাদের সংখ্যা বাড়লেও চাকরির সুযোগ বাড়ছে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে শিল্প-কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি বা সম্প্রসারণ ঘটছে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টির সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি খাতে বরাদ্দের অভাব পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ইউজিসির তথ্য মতে, জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমবেশি ২৯ লাখ। এর বাইরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাড়ে তিন লাখের মতো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ৩৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছে ৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৮২ জন। ওই বছর ৭৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে ৬৫ হাজার ৩৬০ জন। সব মিলিয়ে ২০১৪ সালে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ৩০২ জন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছে। এর বাইরে পাশ করতে পারেনি বা ঝরে গেছে এমন শিক্ষার্থী সংখ্যা আরও বেশি। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা সম্পন্ন করেছে আরও কয়েক লাখ যুবক। কিন্তু এদের মধ্যে চাকরি হয়েছে হাতে গোনা কিছু যুবকের। একইভাবে প্রতি বছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন, অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না।

বিভিন্ন আলোচনা সেমিনারে জ্ঞানী-গুণীরা বক্তব্য দেন-‘বেকার মানুষ দেশ ও জাতির বোঝাস্বরুপ। নিজের কাছে সে অপরাধী, অপরাধী পরিবারের কাছেও।’ এ ধরণের বক্তব্যে বারবার হতাশ থেকে আরো হতাশ হয়ে পড়ে তরুণরা।

সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, কাজের সুযোগ না পেয়ে অসংখ্য বেকার যুবক হতাশা থেকে জঙ্গীবাদসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। হতাশা থেকে আত্মহননের পথও অনেকে বেছে নিচ্ছেন। একই কারণে নিকটাত্মীয়কে হত্যা করার মতো ঘটনাও এই সমাজে ঘটছে।শিক্ষিত যুবকদের অনেকেই হতাশা থেকে মাদকের সংস্পর্শে আসছেন। এই সুযোগে মাদক বাণিজ্যসহ অনেক বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আয় রোজগারের পথ খুঁজছেন অনেকে।

বেকার জীবনের গ্লানি বহন করা সত্যিই দুরূহ। এটি যেমন একদিনে তৈরি হয়নি, তেমনি রাতারাতি দূর করাও সম্ভব নয়। অস্বাভাবিক বেকারত্ব যে কোনা দেশের আর্থ সামাজিক উন্নতির পথে এক দুর্লঙ্ঘ বাধা। তাই সুনির্দিষ্ট ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের বিকাশ, আত্মমর্যাদা এবং জাতীয় উন্নতির স্বার্থে বেকারত্ব লাঘবের সমন্বিত প্রয়াস জরুরি।

লেখক : শিক্ষার্থী, চবি।