ভাইরাল বা হিরো হওয়ার জন্য কিছু করিনি : কনস্টেবল উজ্জ্বল কুমার

একজন মানবিক পুলিশ কনস্টেবল উজ্জ্বল কুমার রায়। তিনি বলেন, ভাইরাল বা হিরো হওয়ার জন্য কিছু করিনি। সে রকম কিছু আমার মাথায়ও আসেনি। ব্যবসায়ীদের কান্না আর আহাজারি বুকে বেঁধেছিল। নিজের মনুষ্যত্ব নাড়া দিচ্ছিল, মাথায় শুধু কাজ করছিল কিছু একটা করতে হবে। এর মধ্যেই সুযোগ আসে। ঊর্ধ্বতন স্যারদের নির্দেশ পেয়ে অস্ত্র জমা রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ি পুড়তে থাকা ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের মালামাল সরানো এবং আটকে পড়া দোকানিদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনার কাজে।

এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন গত শনিবার (১৫ এপ্রিল) ভোরে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে লাগা আগুনের ঘটনায় জীবন বাজি রেখে উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া পুলিশ কনস্টেবল উজ্জ্বল কুমার রায়। আগুনের ঘটনায় অনেকে উদ্ধার কাজে অংশ নিলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উজ্জ্বল কুমারের মানবিকতার বেশ কয়েকটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। প্রশংসা পান সবার।

উজ্জ্বল কুমারের বাড়ি লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রাম ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীখাতা গ্রামে। তার মা তাপসী রানী গ্রামের বাড়িতে কাজ করেন। বাবা রবীন্দ্র নাথ একজন সাইকেল মেকানিক। নিজেদের জমি না থাকায় অন্যের জমিতে একটি ঘর তুলে থাকেন তারা। তবুও বাবা-মায়ের ইচ্ছে তাদের সন্তান মানুষের মত মানুষ হয়ে দেশের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখবে। তাদের সেই স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে। উজ্জ্বলের পরিবারে বাবা-মা ও তার স্ত্রীসহ একমাত্র বোন আছেন। বোন তুষভান্ডার মহিলা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী।

সোমবার (১৭ এপ্রিল) দুপুরে কনস্টেবল উজ্জ্বলের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়। ওই সময় মা তাপসী রানীর কথা বলতে গিয়ে চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে।

এলাকাবাসী জানান, উজ্জ্বলের পরিবারের একটি জরাজীর্ণ ঘর রয়েছে। সেই ঘরেই থাকে তার বাবা-মা ও স্ত্রীসহ একমাত্র বোন। যদিও ওই ঘরটি অন্যের জমিতে অনুমতি নিয়ে তোলা। বাবা সাইকেল মেকানিক। সন্তানদের লেখাপড়া করাতে তার আয়ের টাকা শেষ হয়ে যায়। তাই তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসারের অর্থ যোগান দেন। বাবা-মায়ের কষ্ট কখনো সন্তানদের বুঝতে দেননি। তারা চেয়েছেন তাদের সন্তান স্ব-শিক্ষিত হয়ে দেশের মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনুক। উজ্জ্বল রায় ছোট থেকে অনেক সহজ সরল মনের মানুষ ছিলেন। প্রায় ৫ বছর আগে পুলিশে চাকরি হয় তার। কোনো অর্থ ছাড়াই চাকরি পেয়ে যোগ দেন। কিন্তু পাঁচ বছরে তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই তাদের জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছে স্থানীয়রা।

প্রতিবেশী রণজিৎ কুমার রায় বলেন, উজ্জ্বল সব সময় শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কখনো কারো প্রতি রাগ করেনি। কখনো কেউ রাগ দেখালে হেসে শেষ করে দেয়। ঢাকায় ব্যবসায়ীদের পাশে সে দাঁড়িয়েছে তাই আমরা গর্বিত।

তার স্ত্রী নিরুপমা রানী বলেন, আমি সব সময় চেয়েছিলাম যে একটা সৎ মানুষ আমার জীবনে স্বামী হিসেবে আসুক। সৃষ্টিকর্তা সেই আশা পূরণ করেছেন। তার সঙ্গে প্রায় ৩ বছরের সংসারে কখনো কোনো ধরনের কটু কথা হয়নি। নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কথা ভেবে তাদের মালামাল উদ্ধারে যে আমার স্বামী ভূমিকা রেখেছেন, এতে আমরা গর্ববোধ করছি।

উজ্জ্বলের মা তাপসী রানী বলেন, আমি সব সময় চেয়েছি, সে বড় হয়ে মানুষের জন্য কাজ করবে। কিন্তু আমরা জানতাম না সে পুলিশের চাকরি পাবে। যখন পুলিশের চাকরি পায় তখন বুক ভরে গিয়েছিল। আজ ছেলে সৎ পথে থেকে মানুষের জন্য কাজ করছে। যতই কষ্ট হোক তাকে সৎ পথে থেকে মানুষের সেবা করতে হবে।

তার বাবা রবীন্দ্র নাথ বলেন, সাইকেল মেকারি করে তাকে মানুষ করেছি, কখনো ভাবেনি পুলিশের চাকরি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবে। ছোট থেকেই সে অনেক সহজ সরল ছিল, নিজে গরিব হলেও আমাদের টাকার প্রতি লোভ নেই। ভাঙা বাড়িতে থাকি তো কি হয়েছে মানুষতো আমাদের ঘুষখোর বলতে পারবে না।

পারিবারিক অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে উজ্জ্বল কুমার রায় বলেন, আমার পরিবার অনেক কষ্ট করে আমাকে মানুষ করেছেন। তাদের এই বিশ্বাস যে আমার দ্বারা দেশের মানুষের ক্ষতি হবে না। সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। সৎ পথে আছি, অবশ্যই একদিন সৃষ্টিকর্তা ভালো কিছু দেবেন সেই বিশ্বাস আছে এবং থাকবে।

কালীগঞ্জের কে ইউ পি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খুরশিদুজ্জামান আহমেদ বলেন, ২০১৫ এসএসসি ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিল উজ্জ্বল রায়। শিক্ষার্থী হিসাবে আচার-আচরণ চালচলন কথাবার্তা পোশাকে সে আদর্শ শিক্ষার্থীর পরিচয় দিয়েছিল। আর সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবার কাছে অনুকরণীয়। তবে এখনো তার বাবা-মা জরাজীর্ণ বাড়িতে থাকছেন। আশা করছি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যারা আছেন তারা এই বিষয়ে দৃষ্টি দেবেন।’