প্রখ্যাত শ্রমিকনেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী রবিবার (৭ মে)।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের তৎকালীন সংসদ সদস্য টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম.এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হন। ভাওয়ালের শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার ১৯৭১ সালে জীবন বাজি রেখে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে লড়ে তিনি এনে দিয়েছেন দেশের জন্য লাল-সবুজের পতাকা ও মানচিত্র।

আহসান উল্লাহ মাস্টার ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও শ্রমিক নেতা। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর-২ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতীম সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য দেশবরেণ্য রাজনীতিক আহসান উল্লাহ মাস্টারের জন্ম ১৯৫০ সালের ৯ নভেম্বর, তৎকালীন গাজীপুর জেলার পুবাইল ইউনিয়নের হায়দরাবাদ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। মাতা বেগম রোসমেতুন্নেসা ও বাবা হযরত শাহ সূফি মুহম্মদ আবদুল কাদের পাঠান পীর। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ গ্রামের হায়দরাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি টঙ্গী হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে এসএসসি পাস করে তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে (বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ) একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে ডিগ্রি পাস করার পর আহসান উল্লাহ টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে তিনি ওই স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক (১৯৭৭-১৯৮৪) ও প্রধান শিক্ষকের (১৯৮৪-২০০৪) দায়িত্ব দক্ষতার সহিত আমৃত্যু পালন করেন। আহসান উল্লাহ মাস্টার টঙ্গী শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবেও সক্রিয় ছিলেন।

কিশোর বয়সেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা ঘটে আহসান উল্লাহ মাস্টারের।১৯৬২-এ হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। রাজনীতির লড়াকু সৈনিক হিসেবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠতে থাকে। তিনি পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে রাজনীতি চালিয়ে যেতে থাকেন। পরবর্তীতে হয়ে উঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের অনুসারী।

১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার চক্রান্ত করে। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহ করার নিমিত্তে টঙ্গী-জয়দেবপুরের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন আহসান উল্লাহ। তিনি কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে ‘মুজিব তহবিল’-এর জন্য প্রতিটি কুপন ১০ পয়সা করে বিক্রয় করেন। ১৯৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ এর এগার দফার আন্দোলনেও সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি।দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে আহসান উল্লাহ মাস্টার মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ জয়দেবপুরের ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে ঢাকা থেকে আসা পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যারিকেড দিয়ে বাধা দেয়ার জন্য জনতাকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ডাক দেন বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার। বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে ঘর ছাড়েন আহসানউল্লাহ মাস্টার। তবে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হন এবং নির্যাতিত হন। আহত অবস্থাতেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ভারতের দেরাদুনের তান্দুয়া থেকে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে পুবাইল, টঙ্গী, ছয়দানাসহ বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন আহসান উল্লাহ মাস্টার ছিলেন সংগঠন অন্ত:প্রাণ মানুষ।

তিনি ১৯৮৩ এবং ১৯৮৮ সালে পূবাইল ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৯০ সালে তিনি গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। জাতীয় শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও কার্যকরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) চেয়ারম্যান ছিলেন। শিক্ষক সমিতিসহ বিভিন্ন সমাজসেবামূলক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সালে শ্রমিকদের জন্য ৯টি বস্ত্রকল নামমাত্র মূল্যে সমবায় সমিতির মাধ্যমে পরিচালনা করার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। আহসানউল্লাহ মাস্টার ১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক পটভূমিতে শ্রমজীবী নেতা হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি শিক্ষকদের নেতা ছিলেন। টঙ্গীর শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের সব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে হয়ে ওঠেন সবার প্রিয়ভাজন।

২০০৪ সালের ৭ মে। শোক-বিহ্বল এক দিন। রোজকার মতই, সেদিনও আকাশ ছিল সূর্যোজ্জ্বল। কিন্তু দিনেই সেদিন ঘনিয়ে এলো রাতের চেয়েও ঘন-কালো-নিকষ অন্ধকার। বিএনপি-জামাতের সন্ত্রাসীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ধেয়ে এলো। মানুষের চেহারায় তারাই যমদূত। ঠাস! ঠাস! গুলির আওয়াজ। বুলেটের আঘাতে লুটিয়ে পড়লেন গাজীপুরের কৃতিসন্তান, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার প্রিয় মানুষ, প্রিয় ‘স্যার’ আহসানউল্লাহ মাস্টার। যে স্কুলে তিনি প্রধান শিক্ষক, সেই স্কুলের বিজ্ঞান ভবনের সামনে রক্তে রঞ্জিত হয়ে নিথর পড়ে রইলেন আমৃত্যু এই শিক্ষানুরাগী।
উল্লেখ্য শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের বড় ছেলে জাহিদ আহসান রাসেল এমপি বর্তমানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর ছোট ছেলে জাবিদ আহসান সোহেল ২০১৩ সালের ১২ জুলাই ৩৩ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।তার মৃত্যু বার্ষিকীতে পরিবার, দলীয় নেতৃবৃন্দ সহ এমনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের লোকজন।

এব্যাপারে ময়মনসিংহের লেখক ও গবেষক সাংবাদিক সুমন বলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার তিনি দেশ-জাতির কল্যাণে অনেক ভালো কাজ করে গেছেন। উনার মৃত্যু বার্ষিকীতে জাতি গভীর ভাবে স্বরণ করবে।