ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বেও বঙ্গবন্ধু : পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদন

বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ থেকে ৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইতিহাসবিদ এমনকি ভাষা আন্দোলনকারীরাও অজানা কারণে বিষয়টি এতদিন তুলে আনেননি। কিন্তু সে সময় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার যে প্রতিবেদন নিয়ে বই প্রকাশ হয়েছে, সেখানে ঠিকই সেগুলো স্থান পেয়েছে।

১৯৪৭ সালে বৃটিশ রাজের অবসানের পর পাকিস্তার সৃষ্টির এক বছরের মধ্যেই আন্দোলনে নামতে হয় বাঙালিদের। এই বাংলার মানুষের আন্দোলনেই যে দেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেখানে বাঙালিরাই যে ঠকে গেছে তা প্রকাশ পায় ১৯৪৮ সালেই। যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই অনুষ্ঠোনেই প্রতিবাদ উঠেছিল এবং সেই প্রতিবাদে ছিলেন সে সময়ের ছাত্রনেতা তরুণ শেখ মুজিব। আর আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি গ্রেপ্তারও হন। আর ৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের যখন চূড়ান্ত রূপ, সেদিন তিনি কারাগারেই।

সে সময় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন নিয়ে প্রকাশিত হওয়া বই ‘সিক্রেট ডকুমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স ব্রান্স অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ এ কিন্তু তরুণ শেখ মুজিবের ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা ঠিকই উঠে এসেছে।

বইয়ে সংযুক্ত গোয়েন্দা নথিতে বলা হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান নামটি পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের নজরে আসে ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকেই। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’, যার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৩ জানুয়ারি রমনার বর্ধমান হাউজে মুসলিম লীগের পার্টি বৈঠকে এ যোগ দেন শেখ মুজিব সহ ছাত্রদের একাংশ। ওই বৈঠকে নিয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিব সহ অন্য ছাত্ররা একটি বুকলেট বিতরণ করে। যাতে লেখা ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের দূর্ভাগা জনতা, কৈফিয়ত দিতে হবে আমাদের। ‘

৩ মার্চ লালবাগ থানায় এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমানে স্বাক্ষর করা একটি লিফলেট ছাড়া হয়েছে। যাতে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে কেন আলাদা ছাত্রলীগ গঠন করা হয়েছে।’

৪ মার্চ ঢাকা জেলা গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান সহ যারা মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে কাজ করেছে তারাই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে লিফলেট ছড়াচ্ছে।’

২৩ ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিশোধে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে মেনে নিতে হবে। এর তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে শেখ মুজিব যোগাযোগ শুরু করেন তৎকালীন ছাত্রনেতা এবং রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে।

২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে এক বৈঠক হয়। সেখান থেকেই ১১ মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চ বিক্ষোভ মিছিল আসে সচিবালয়ের সামনে। সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যদের।

৩ এপ্রিল গোয়েন্দাদের দেয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ মার্চ গোপালগঞ্জে প্রায় ৪০০ ছাত্র বিক্ষোভ করে। তারা শেখ মুজিবুরের মুক্তির দাবিতে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্লোগান দেয়।

প্রশ্ন উঠেছে ভাষা আন্দোলনে জাতির জনকের সক্রিয় অংশগ্রহণ, অসামান্য অবদান এত বছর কেন প্রকাশিত হয়নি। ভাষা আন্দোলনকারীদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর এই অবদানের কথা স্বীকার করেননি।

এই আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা কেবল গোপন করা হয়নি, রীতিমতো অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কেন সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি কখনও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘১৮৪৮ এবং ৪৯ সালের ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। সেই সময়ে যারা ভাষা অন্দোলনকে নানাভাবে নেত্বত্ব দিয়েছেন তিনি তাদের অন্যতম।’

‘ভাষা অন্দোলনে তাঁর ভূমিকাকে কোনেভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কেউ যদি এমনটা মনে করে তা হবে ইতিহাস বিকৃতি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘আমরা শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগ এবং ১৯৭১ এর মধ্যেই রাখতে চাই। কিন্তু আমরা ৭১ এ কীভাবে পৌঁছালাম? ভাষা আন্দোলনের দুটি সময়কাল ছিল। ১৯৫২ তে আমরা ভাষা পাই। কিন্তু এটা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। এটা নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তথ্যগুলো উঠে এসেছে। কিন্তু ওইভাবে উঠে আসেনি। ১৯৭১ এর মত ১৯৪৮ সালে থেকে তার যে অবদান এটা তুলে ধরতে হবে। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিটা ১৯৪৮ সাল থেকেই।’

এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘তিনি তো একদিনে বঙ্গবন্ধু হননি৷ তার এই বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠাটা ১৯৪৮ সাল থেকেই।’