ভিনদেশে এক মানবিক প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছে রোহিঙ্গারা
বুথিডংয়ের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম। তার সঙ্গে কথা হয় উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে। জানা অজানা নানা বিষয়েই সে তার স্মৃতিতে থাকা তথ্য বলতে থাকে। যেগুলো ধারণার বাইরে ছিলো সেগুলোও যেমন বলছিলো গড়গড় করে, তেমনি যেগুলো জানা সেগুলোও। ১৯৯০ এবং ২০১৫ এই দুইবারই নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে সু চি। তার ক্ষমতায় আসায় সবথেকে বেশি আশাবাদী হয়েছিলো রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের আশাবাদী হওয়ার পেছনেও বেশ কিছু কারণ ছিলো। শত শত বছর ধরে মিয়ানমারে যে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস রচিত হয়েছে সেখানে সেনাবাহিনী এক আতঙ্কই রোহিঙ্গাদের কাছে। যে সেনাবাহিনী দেশটিকে যুগের পর যুগ ধরে শাষণ করেছে, সে সেনাবাহিনীর নাম শুনলেই রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক অজানা সংশয়।
রোহিঙ্গারা ভেবেছিলো সু চি ক্ষমতা গ্রহণ করলে হয়তোবা সেনাবাহিনীর এ প্রভাব থেকে মিয়ানমারকে কিছুটা হলেও মুক্ত করবে। তবে যে যায় লংকায় সেই হয় রাবন এ প্রবাদ বাক্যের বাইরে যে সু চিও নন তা হয়ত জানতো না রোহিঙ্গারা। গণতন্ত্র তো দূরের কথা, ধর্মীয় উন্মাদনা এবং জাতিগত বিদ্বেষ সু চি আর সামরিক বাহিনী মিলে মিশেই বাড়িয়ে দিয়েছে। যে সু চি সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করে গেছেন সেই সু চি ক্ষমতার লোভে হাত মিলিয়েছেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে। নিজের ক্ষমতাকে তুলে দিয়েছেন সেনাবাহিনীর ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হিসেবে। সেনাবাহিনীও যা ইচ্ছা করিয়ে নিয়েছে। রোহিঙ্গা তাড়াতে মুসলিম তকমার সাথে বাঙালি তকমাও যে যথেষ্ট কার্যকর তাও সেনাবাহিনী বুঝেছে। রোহিঙ্গাদের তাড়াতে সেনা চৌকিতে হামলার একটি ঘটনাকে অজুহাত বানিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশছাড়া করার ষড়যন্ত্রও সেনাবাহিনী বাস্তবায়ন করছে সু চিকে দিয়েই। হয়ত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলার কোন সাহসই তার নেই,। আবার না ক্ষমতাই হারাতে হয়! বলছিলেন বুথিডংয়ের মকবুল হোসেন।
সু চির মুসলিম বিদ্বেষ নিয়ে একটি প্রচলিত গল্প শুনেছিলাম এক বাঙালির কাছে। অক্সফোর্ডে পড়া অবস্থায় এক মুসলিম ছেলের কাছ থেকে প্রতারিত হয়েই নাকি সু চির এই মুসলিম বিদ্বেষ। তবে অতীত প্রেম যে রাষ্ট্র পরিচালনায় বাধা হওয়া উচিত না তা হয়ত তিনিও ভালো করে জানেন। আর প্রেম তো সৃষ্টি করে, সেখানে মানুষ হত্যাই বা স্থান পাবে কিভাবে? যে কারণেই হোক মিয়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের কোন যুক্তিতেই দেশছাড়া করা ঠিক নয়।
রহিম নামের এক বাঙালি বলেন, রোহিঙ্গাদের শুধুমাত্র মুসলমান তকমা লাগিয়ে দেশছাড়া করা এবং বৌদ্ধদের কাছে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ভুল তথ্য উপস্থাপন করার বিষয়টি হয়ত একদিন সবার কাছে পরিষ্কার হবে। বৌদ্ধরাও হয়ত তাদের ভুলটি বুঝবে। তাদের মত রোহিঙ্গারাও যে মিয়ানমারেরই নাগরিক তাও তারা ভালো ভাবেই জানতে পারবে। সেদিন হয়ত খোদ মিয়ানমারেই সু চির জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামবে। যারা তাকে ‘গণতন্ত্রের নেত্রী’ বলে বুলি ছুঁড়ছেন তারাই একদিন তাকে বিশ্বাসঘাতক উপাধি দিয়ে দেবেন। এমন ধারণা অনেক সচেতন রোহিঙ্গারই। যদিও পরবর্তিকালে গণতন্ত্রের নেত্রী অ্যাখা দিয়ে তাকে দেওয়া বেশ কয়েকটি সম্মাননা থেকে তার নাম প্রত্যাহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে ৯০ এর দশকে তার পক্ষে আন্দোলন করেছেন এমন লোকের সংখ্যা অনেক। আমাদের আলোচনা শুনে আশপাশ থেকেও কিছু মুরব্বী লোক হাজির। তারা জানালো তাদের ইতিহাসের কথা। এক মহিলা হাজির হলো রাবেয়া খাতুন নামের। তার সন্তান সংখ্যা ১৫জন। একাধিক বিয়ের যেমন প্রবণতা রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে, তেমনি একাধিক সন্তান নেওয়াকেও তারা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। সন্তান বেশি হলে খাবার সংগ্রহ করতে তাদের সুবিধা হয় বলছিলো রাবেয়া। রাবেয়া একটু পর বললো. পরিবারের সদস্য বাড়লে জোরও বেশি থাকে।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় তখন বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম বাংলাদেশ। ১২ সেপ্টেম্বর উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শনে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের একটা বড় অংশই তখন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের পাশাপাশি তখন বালুখালীর টিলাগুলোতেও রোহিঙ্গারা যে যার মত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছে। একরের পর একর সবুজ পাহাড় নিমেষেই শূণ্য হয়ে যাচ্ছে। যেদিন প্রধানমন্ত্রী কুতুপালং যান সেদিন বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের সবাই ছুঁটেছে কুতুপালংয়ের পথেই। কেউবা অক্ষত অবস্থায় কেউবা সামান্য আঘাত পেয়ে আবার কেউবা গুরুতর আঘাত নিয়ে পথের পাশেই অপেক্ষায় আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেখার। ছোট বেলায় আমরাও এমন অপেক্ষা অনেক করেছি। আমার নিজ জেলা গোপালগঞ্জ। যে জেলাতেই বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্ম নিয়েছেন। কাশিয়ানী উপজেলায় আমাদের জোনাসুর গ্রামটি আশপাশের অনেক গ্রাম থেকে বড়। বড় একটি মাঠ থাকায় বিভিন্ন সময় আমাদের গ্রাম ও এর আশপাশে অনেক নেতার আগমন ঘটেছে। রাস্তার পাশে অপেক্ষায় থেকেছি তাদের দেখতে। যাদের টিভিতে দেখি তারা কেমন? তারা কী সত্যিই এমন! আমাদের মতই! নাকি অন্য রকম। অনেক সময় মনে হয়েছে একটু ছুঁয়ে দেখি! কত কৌতুহল! তবে রোহিঙ্গাদের এ অপেক্ষার মধ্যে কোন কৌতুহল ছিল না, ছিল কৃতজ্ঞতাবোধ।
রোহিঙ্গা-শেখ হাসিনাযে নেতার সিদ্ধান্তে তারা আশ্রয় পেয়েছেন, অন্ন পেয়েছেন, তারা অপেক্ষা করছিলেন জীবন বাঁচানো সেই নেতাকে দেখতে। সকাল ১১টার দিকে কুতুপালং পৌছান প্রধানমন্ত্রী। স্বামী-সন্তান হারিয়ে কোনমতে বেঁচে আসা স্ত্রী, বাবা-মা হারানো সন্তান, সবার কথাই মনোযোগ দিয়ে শোনেন প্রধানমন্ত্রী। এক মানবিক প্রধানমন্ত্রীকে দেখে রোহিঙ্গারা। নিজ দেশে রক্ত দিয়ে যে সু চিকে ক্ষমতায় আনতে লড়েছেন এই রোহিঙ্গারা, তাকেও তারা দেখেছেন। তারা দেখেছেন, ক্ষমতা পেয়ে রোহিঙ্গাদের কথা ভুলে যাওয়া সু চিকে। আবার দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে দেখছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সেদিন শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন। পরে এক ভাষণে তিনি রোহিঙ্গাদের পাশে থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। রোহিঙ্গাদের ভরসা দেন যতদিন মিয়ানমার সরকার তাদের ফেরত না নিচ্ছে ততদিন বাংলাদেশের মানুষ খেয়ে থাকলে রোহিঙ্গারাও খেয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ উদারতার প্রশংসায় মুখর তখন বিশ্বমিডিয়া। ব্রিটেনের চ্যানেল ফোর তো তখন শেখ হাসিনার উখিয়া ক্যাম্প পরিদর্শন নিয়ে করা প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাব দিয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন ক’দিন পরেই। রোহিঙ্গা ইস্যুটি সেখানে জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন কিভাবে আদায় করা যাবে সে বিষয়েও তখন হোমওয়ার্কও শেষ করে নিচ্ছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনই তখন বাংলাদেশের টার্গেট। যদিও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সু চি তখন ওই অধিবেশনে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সূত্র : চ্যানেল আই অনলাইন
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন