২০ দিনেও খোঁজ মেলেনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সিজারের

নিখোঁজের ২০ দিন পরও খোঁজ মেলেনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মুবাশ্বার হাসান সিজারের। সিজারকে উদ্ধারে একযোগে কাজ করছে র‌্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। তবে সিজারের খোঁজ না পাওয়ায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে স্বজনদের। বাবাকে কাছে পাওয়ার অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না তার মেয়ে আরিয়ানার।

বাবা নিখোঁজের ঠিক ২০ দিন পর আজ ২৭ নভেম্বর মেয়ে আরিয়ানার জন্মদিন। কিন্তু বাবাকে কাছে পাওয়া হলো না মেয়ের। এ নিয়ে মুবাশ্বারের বোন তামান্না তাসমিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

তামান্না তাসমিন লিখেছেন, নিজের সন্তান না থাকলে নাকি বাবা/মায়ের উৎকণ্ঠা বুঝা যায় না। হয়তো… কিন্তু নিজের সন্তান থেকে দূরে থাকার যে কি যন্ত্রণা, সেটা আমার ভাইয়া কে দেখে ওর আশপাশের সবাই বুঝতো। মেয়ের প্রতি ওর এই ভালোবাসা অন্য বাবাদের থেকে অনেক আলাদা। কারণ সে চাইলেই সব সময় মেয়েকে কাছে পেতো না। এতো সৌভাগ্য ছিল না ওর যে ইচ্ছা হলেই নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। আর আজ সেই মেয়ের জন্মদিনে ও কত দূরে, কোন অজানায়।

তিনি লিখেছেন, আমার সদা ব্যস্ত ইন্টেলেকচুয়াল ভাইয়ের শুক্রবার মানেই আরিয়ানা দিবস। বাপ বেটি শুক্রবার সারা দিন টইটই করে ঘুরবে, খেলবে। ভাইয়ার চেহারায় সেই একটা দিন অন্যরকম খুশি লেগে থাকতো। সেই দিন কখনো অন্য কোনো কাজ রাখতো না ও। সেই দিন গোটা দুনিয়া উল্টে গেলেও ওর কিছু যাবে আসবে না। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে গত রাতে দেয়া সেই স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, গত বছর কোরবানি ঈদের সময়ের কথা। আব্বু আর ভাইয়া হাটে গেছে গরু কিনতে। কিন্তু গরু নিয়ে বাসায় ফিরলো আব্বু একা। কেন? কারণ, হঠাৎ জানা গেছে আরিয়ানা আজ দেখা করবে। ব্যাস, আমার ভাই সব ছেড়েছুড়ে দৌড় দিয়েছে। আমার ভাইয়ের গোটা দুনিয়া জুড়ে আছে এই ছোট্ট মেয়েটা। ওর মেয়ে ওর বন্ধু, ওর বাঁচার সবচেয়ে বড় অবলম্বন। প্রতিদিন ভাইয়া বাবুর নানীকে কল দিয়ে বলতো ‘এই আমার মেয়ে কি করে?’ বাবু জেগে থাকলে অল্প কিছুক্ষণ কথা হতো। বাপ মেয়ের যোগাযোগ বলতে শুক্রবারের দেখা হওয়া আর এই ফোনে কথাটুকুই। এই আধো আধো বুলিতে যে এতো মায়া, এতো ভালোবাসা। শেষবার দেশের বাইরে যাওয়ার সময় ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আরিয়ানা কে কল দিয়ে ভাইয়া বলেছিল, আম্মু, বাবা বাইরে যাচ্ছি। অনেক লম্বা জার্নি। তুমি দোয়া করো বাবার জন্যে, কেমন? আমি জানি খুব ভালো করেই এই এতটুকু কথা না বলে ফ্লাইটে উঠতে হলে ভাইয়ার জার্নি শান্তির হতো না।

স্ট্যাটাসে তামান্না আরও লিখেছেন, আরিয়ানা একবার বলেছিল, আব্বু ভিডিও কল দাও, তুমি কোন পনি কিনেছো আমি দেখি! নেটওয়ার্ক প্রব্লেমের কারণে ভিডিও কল কাজ করছিল না। যতক্ষণ না ক্লিয়ার ভিডিও তে মেয়েকে দেখেছে, আমার ভাই আমার মাথা মোটামুটি খারাপ করে ফেলেছে। কারণ, যতগুলা অপশন আছে ভিডিও কল করার, সবগুলা বাবুর নানীকে বুঝায় দিয়ে, ফোনে ইন্সট্রাকশন দিয়ে নামানো লেগেছিলো আমার। যদি কখনো শুনতো বাবুর শরীর খারাপ তখন ওর অসহায়ত্বটা আরো প্রখর হয়ে উঠতো। বারবার ওর ন্যানিকে কল দিতো। বাসায়ও সেই সময়গুলাতে কারো সাথে তেমন কথা বলতো না। আমার সদা হাস্যজ্বল ভাইয়ের মুখ গোমড়া থাকলে আমি আন্দাজ করতে পারতাম যে হয় আরিয়ানার সাথে আজকে কথা হয়নি নাহলে বাবু অসুস্থ। বাবুর প্রতিটা কথা, প্রতিটা আবদার ওর জন্যে মহামূল্যবান ব্যাপার ছিল। বাবুর কোন কোন কথা এনালাইসিস করার সময় ও বলতো, দেখসো ও কতো শার্প মাশাল্লাহ। ও অনেক ডিপলি অবজার্ভ করে সবকিছু বুঝছে! গোটা দুনিয়া চষে বেড়ানো ছেলেটা শুধু এই ছোট্ট ২টা হাতের বাঁধনে বাধা ছিল।

তামান্না লিখেছেন, বাবুর জন্মদিন মানে আমাদের বাসার সবচেয়ে বড় উৎসব। গতবার ওর জন্মদিন বাইরে বড়ো করে করা হয়েছিল। রেস্টুরেন্ট, গেমস, ম্যাজিক, কেক সব ভাইয়া একা হাতে ম্যানেজ করেছিল। যেন পারলে ওই একটা দিন গোটা দুনিয়া বাবুর পায়ে এনে দেয়। আর আজ …… বাবুর ষষ্ঠ জন্মদিনে ও কোথায়? এতদিন ও কেমন ছিল আমি জানি না। কিন্তু আমি জানি আজকে ও কাঁদছে। আমি জানি আজকে ও নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্ভাগা মানুষ মনে করছে। আজকে বাবুকে কোলে নিতে না পারার কষ্টে ওর বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আজকে বাবুর কণ্ঠে “বাবা” ডাকটা শুনার জন্যে ওর ব্যাকুলতা মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের বাঁচার জন্যে আকুলতার চেয়ে কোনো অংশে কম না। আমি জানি এবারও নিজের সাধ্যের মধ্যে বড়ো করেই আয়োজন করতো একমাত্র মেয়ের জন্যে ও। কিন্তু পারলো না। এতো মানুষের এতো কান্না, এতো অনুরোধ, কিছুতেই কিছু হলো না। একমাত্র মেয়ের জন্মদিনে বাপ বেটির এক হওয়া হলো না।

স্ট্যাটাসের শেষ দিকে সবার উদ্দেশে তামান্না লিখেছেন, আমি জানি, আমার ভাই নিখোঁজ হওয়াতে কারো কিছু যায় আসে না। এতো কোটি মানুষের ভিড়ে একটা বাবার তার সন্তানের জন্যে এই দুর্বিসহ হাহাকার হয়তো খড়ের গাঁদায় সুঁইয়ের মতোই। কিন্তু তবুও আমি একটা অনুরোধ করতে চাই, আমার ভাইয়ের জায়গায় নিজেকে একটু রেখে কল্পনা করেন তো! বেশি না, মাত্র ২ টা মিনিট …….. পারেননি ……..আমি জীবন বাজি রেখে বলতে পারি। ছুঁটে গিয়ে নিজের সন্তানকে জড়িয়ে ধরেছেন। আমার ভাইয়ের কষ্ট কি একটু হলেও অনুধাবন করতে পারেন আপনারা এখন? তাহলে বলেন, আমার ভাইটা কেন পারবে না তার একমাত্র মেয়ের জন্মদিনে মেয়েকে কোলে নিতে? একটা ছয় বছরের অবুঝ শিশুকে কেন মিথ্যা কথা বলে ভুলিয়ে রাখতে হবে? আপনি ২ মিনিট পারেননি, সেখানে আমার ভাই ২০টা দিন ধরে তার মেয়ের থেকে দূরে আছে। এতটাই অভাগা সে যে, মেয়ের জন্মদিনে উইশটা পর্যন্ত করতে পারলো না, আদর করে দিতে পারলো না। বলতে পারলো না, আম্মু, আমি তো দূরে আছি, আমার জন্যে তুমি দোয়া করো। বাবুর আধো আধো কণ্ঠে বাবা ডাকটা শুনতে পারছে না।’

উল্লেখ্য, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুবাশ্বার হাসান সিজার গত ৭ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন সিজার। পরে যুক্তরাজ্যে মাস্টার্স ও অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করেন তিনি। বছরখানেক তিনি ঢাকায় সাংবাদিকতাও করেন। অধ্যাপক ড. মুবাশ্বার হাসান সিজার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও জার্নালে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন।