ভোটে প্রভাব ফেলবে সরকারের ডজনখানেক মেগা প্রকল্প
অর্থনীতির চালচিত্র বদলে দিতে ডজনখানেক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এসব প্রকল্পের ১০টি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার ফাস্ট-ট্র্যাকে অন্তর্ভুক্ত। মেগা এসব প্রকল্প ঘিরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বড় প্রচারণা। পদ্মা সেতুর মতো বড় এসব প্রকল্পের ধারাবাহিকতা রাখতে ভোট চাওয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের পক্ষ থেকে।
এসব মেগা প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার প্রকল্পে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৬ হাজার ৯৬৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অর্থ ব্যয়ের হিসাবে সার্বিক অগ্রগতি ৫৬ দশমিক ২০ শতাংশ। মূল সেতু নির্মাণে অগ্রগতি ৭১ শতাংশ। নদী শাসন কাজ হয়েছে ৪৭ শতাংশ। জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়ক, মাওয়া প্রান্তে সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া-২-এর কাজ হয়েছে শতভাগ।
শুরু থেকেই নানামুখী সঙ্কটে বাধাগ্রস্ত হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ। অর্থায়নে চুক্তি সত্ত্বেও দুর্নীতির কথিত ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে যায় দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকও (আইডিবি) সহায়তার হাত গুটিয়ে নেয়। পরবর্তীতে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ঘোষণার পর থেকেই প্রকল্পটি আওয়ামী লীগের সামর্থ্য ও দৃঢ়তার প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
পদ্মা সেতুর সুফল আরো বিস্তৃত করতে এতে রেল সংযোগের উদ্যোগের অংশ হিসেবে চীনের সহায়তায় ২০১৬ সালে নেওয়া হয় ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকার প্রকল্প। ২০২২ সালের জুনে সমাপনীর জন্য রাখা প্রকল্পটিতে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে চলে যায় ২ বছর। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকায়। এর আওতায় ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে যশোর পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপন হবে। পর্যায়ক্রমে রেল যোগাযোগের আওতায় আসবে বরিশাল জেলা। বরাদ্দের ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে ভৌত কাজ হয়েছে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ।
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন পায় ২০০৯ সালে। কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৫ সালে। কয়েক দফায় সংশোধনে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয় উঠেছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায়।
যানজট থেকে ঢাকাবাসীদের মুক্তি দিতে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৭ লাখ টাকার প্রকল্পে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। বরাদ্দের ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ অর্থ এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত লাইন স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে। প্যাকেজ-১ এর শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ৭ শতাংশ কাজ হয়েছে প্যাকেজ-২ এর আওতায়। এ ছাড়া প্যাকেজ-৩-এর ১০ শতাংশ, প্যাকেজ-৮-এর ১০ দশমিক ২০ শতাংশ কাজ হয়েছে। প্যাকেজ-৪, ৫, ৬ ও ৭-এর আওতায় কাজও চলমান আছে।
রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ ১৯৬৩ সালের। পরে কয়েক দফায় নেওয়া উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। বিকল্প জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মেগা এ প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয় ধরে চলছে মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ। এর কাজ শেষ হলে জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ইতোমধ্যে প্রকল্পটির আওতায় ৮ হাজার ৪৬১ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এ পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ।
রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হবে কয়লা। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ওপর চাপ কিছুটা কমে আসবে। ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পে ইতোমধ্যেই ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা ৬৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ১৬ শতাংশের বেশি।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতরাবাড়ী দ্বীপকে বিদ্যুৎ হাবে উন্নীত করছে সরকার। এ বিদ্যুৎ হাবে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মাতারবাড়ী ২,৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রকল্পের কাজ। ২০১৪ সালের ১ জুলাই থেকে চলমান প্রকল্পে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ২০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। বরাদ্দের ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে মাঠ পর্যায়ে কাজ হয়েছে ১৭ দশমিক ৭২ শতাংশ।
গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় বড় আকারের জাহাজে কলম্বো বা সিঙ্গাপুর পর্যন্ত পণ্য এনে ছোট আকারের জাহাজে তা চট্টগ্রাম বা মোংলা সমুদ্রবন্দরে আনা হয়। সরাসরি পণ্য আমদানি-রফতানি নিশ্চিত করতে ৩ হাজার ৩৫০ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয় ধরে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৫ সালে। এ প্রকল্পে ইতোমধ্যেই ৭১৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ২১ শতাংশের বেশি।
বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপন করতে প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১০ সালে। এ লক্ষ্যে দোহাজারী থেকে রামু কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১০৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ৭ শতাংশ আর্থিক অগ্রগতির বিপরীতে ভৌত অগ্রগতি ১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।
শিল্পায়ন ধরে রাখতে অত্যাবশ্যক জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকারি-বেসরকারি অংশীধারিত্বের ভিত্তিতে মহেশখালীতে চলছে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ। এ টার্মিনালের মাধ্যমে সীমিত আকারে গ্যাস আমদানি শুরু হয়েছে। গত বছরের ১৮ জুলাই টার্মিনাল ব্যবহার সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে।
ঢাকামুখী যাত্রীদের যানজট থেকে মুক্তি দিতে ২০১২ সালে নেওয়া হয়েছিল বিমানবন্দর-গাজীপুর র্যাপিড বাস ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ডিসেম্বরে। ২ হাজার ৪০ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় ইতোমধ্যেই দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৪ কোটি টাকায়। প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ। এর কাজ শেষ হলে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত নতুন লাইনের কাজ শুরু হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, চলমান প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়ে যাবে। তবে বড় প্রকল্পের একটিও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। আবার কয়েক বছর চলে গেলেও কিছু প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হয়নি।
তিনি আরো বলেন, প্রকল্প প্রণয়নের সময় নকশায় ত্রুটির কারণে অনেক সময় কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। সংশোধনী অনুমোদন নিতে বাড়তি সময় লাগে। সামর্থ্যের বেশি প্রকল্প নেওয়ায় বড় প্রকল্পগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের অভীষ্ট লক্ষ্যের সঙ্গে বড় প্রকল্প নির্বাচনের মিল আছে। তবে বাস্তবায়ন লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না। প্রকল্পে ধীরগতির কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল পেতে বাড়তি সময় লাগছে।
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিভিন্ন জটিলতার কারণে সরকারের বড় প্রকল্পগুলোর কাজে স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিদেশি সহায়তা পাওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন, পরামর্শক নিয়োগ, ঠিকাদার মূল্যায়নসহ প্রতিটি ধাপেই বাড়তি কালক্ষেপণ করা হয়ে থাকে। ফলে প্রকল্পের কাজ ঝুলে থাকে বছরের পর বছর ধরে।
বিদেশি সহায়তা ছাড়ে বিলম্বের কারণে প্রকল্পের গতি কমে আসে বলে মনে করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। সম্প্রতি বিভাগের এক প্রতিবেদনে সহায়তা ছাড়ে গতি না আসার ১৩ কারণ চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিভাগটি। এতে বলা হয়েছে, অনেক সময় সঠিক পরিকল্পনা না করেই প্রকল্প তৈরি করা হয়। প্রকল্প তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতার অভাব আছে। এর ফলে কাজ শুরুর আগেই অনেক প্রকল্পের প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন করতে হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন