মিতু হত্যার ৩ বছরেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ

সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু ২০১৬ সালের ৫ জুন ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে গিয়ে খুন হন।

চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড়ের কাছে ওআর নিজাম রোডের কাছে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। এ ঘটনায় বাবুল আক্তার অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন। বুধবার পূর্ণ হতে চলেছে মিতু হত্যার তিন বছর।

তিন বছর পূর্ণ হতে চললেও মিতু হত্যা মামলার তদন্ত এখনও শেষ করতে পারেনি পুলিশ। তবে কবে নাগাদ তদন্ত শেষ হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই বলতে পারছেন না তদন্ত কর্মকর্তা।

মামলার বিষয়ে নগর পুলিশ কমিশনার মাহাবুবর রহমান জানান, `তদন্ত শেষ পর্যায়ে। অচিরেই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।` অবশ্য এক বছর আগে একই বক্তব্য দিয়েছিলেন সাবেক পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার।

তবে বর্তমান পুলিশ কমিশনার বলছেন, `নিখুঁত তদন্তের জন্য একটু বেশি সময় নেওয়া হচ্ছে, যাতে তদন্তে কোনো ফাঁকফোকর না থাকে।` বাবুল আক্তারের শ্বশুর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, `কে জড়িত, কে জড়িত না, তা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হবে। সুতরাং এ বিষয়ে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না।`

এ প্রসঙ্গে মামলার বাদী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি।

তবে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন তদন্তে অসন্তোষ ও হত্যাকাণ্ডের জন্য বাবুল আক্তারকে দায়ী করে বলেন, `দুই বছর ধরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। একজন কর্মকর্তার কাছে তিন বছর ধরে মামলাটি পড়ে আছে। তার তদন্ত প্রক্রিয়া সন্তোষজনক নয়। তদন্তের কোনো কার্যক্রম বা অগ্রগতিই জানতে পারছি না।`

মোশাররফ হোসেন জানান, বাবুল আক্তারের পরকীয়া ও মিতুর ওপর বিভিন্ন সময় নির্যাতনসহ নানা প্রসঙ্গে তারা তদন্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলেন। তবে কর্মকর্তা এসব বিষয় খতিয়ে দেখেছেন কি-না, তা তাদের জানা নেই। তবে তারা শতভাগ নিশ্চিত- বাবুল আক্তারের নির্দেশেই এ হত্যা হয়েছে।

মোশাররফ প্রশ্ন করেন, `সে যদি সম্পৃক্ত না হয়, তা হলে একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো কেন? তবে খুনের শাস্তি তো অব্যাহতি হতে পারে না। তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।` তিনি তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনেরও দাবি জানান।

এ মামলার তদন্ত করছেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, `মামলার তদন্ত চলমান। কিছু আসামি পলাতক। তাদের গ্রেফতারের অপেক্ষায় আছি। এর পর অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।`

মিতু হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হল- আনোয়ার, ওয়াসিম, এহতেশামুল হক ভোলা, সাইদুল ইসলাম সিকদার ওরফে সাকু, শাহজাহান, আবু নাসের গুন্নু ও শাহজামান ওরফে রবিন। এর মধ্যে আবু নাসের গুন্নু ও শাহজামান ওরফে রবিনের এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে সাবেক সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার সাংবাদিকদের জানান। অপর চারজনের মধ্যে সাইদুল ইসলাম ওরফে সাকুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি তিনিই সরবরাহ করেছেন তার বড় ভাই মুসা সিকদার ওরফে আবু মুসাকে।

মুসা এ মোটরসাইকেল চালিয়েই মিতু হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়। অপর তিনজনের মধ্যে এহতেশামুল হক ভোলা মিতু হত্যাকাণ্ডে অস্ত্র সরবরাহকারী। শাহজাহান, ওয়াসিম ও আনোয়ার হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল। এ ছাড়া মিতু হত্যায় সন্দেহভাজনদের মধ্যে রাশেদ ও নবী নামে দু’জন পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। বর্তমানে পলাতক আছে মুসা সিকদার ও কালু নামে দু’জন।

পলাতক মুসাকে ধরতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে সিএমপি। তবে এরপরও সে ধরা পড়েনি। গ্রেফতারদের মধ্যে ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মুসার পরিকল্পনায় তারা মিতুকে খুন করেছে বলে জবানবন্দিতে দাবি করে।

মিতু হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তারকে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে ঝিনাইদহে এসআই আকরাম হোসেন নিহতের ঘটনায় বাবুল আক্তার জড়িত বলে ২০১৬ সালের শুরুতে অভিযোগ তোলে তার পরিবার। নিহত আকরামের স্ত্রী বনানী বিনতে বসির বর্ণির সঙ্গে বাবুলের পরকীয়ার অভিযোগ তোলেন তারা। ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে এসে পারিবারিক টানাপড়েন ও পরকীয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বলেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন। তবে তদন্তে এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হলেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এসব অভিযোগের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি বলে জানায় পুলিশ।

মিতুর খুনের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও পরে নগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে মামলার তদন্তভার ন্যস্ত করা হয়। মিতু হত্যার বিচারের দাবিতে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন ও মা শাহেদা মোশাররফ। দ্রুত তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়ার দাবি জানান তারা।

এখন পর্যন্ত এ মামলায় পুলিশ অভিযোগপত্র দিতে পারেনি। কার নির্দেশে মিতুকে হত্যা করা হলো- তা এখনও জানা যায়নি। পুলিশ এ মামলা তদন্তের কোনো অগ্রগতিই জানাচ্ছে না। এ হত্যার প্রধান আসামিও রহস্যজনক কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে। গ্রেফতার ছয়জনের মধ্যে দু`জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তার পরও থমকে আছে তদন্ত। মামলার বাদী বাবুল আক্তারও নীরব এ মামলার ক্ষেত্রে। সবকিছু মিলিয়ে মিতুর পরিবারও এখন হতাশ।