ইউএনওর কাছে মুক্তিযোদ্ধার চিঠি

‘মৃত্যুর পর আমাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেবেন না’

দেশমাতৃকার টানে সম্মুখযুদ্ধে লড়েছেন। পেয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধি। তবে সেই ‘বীর’ উপাধি এখন আর চান না। মৃত্যুর পর দাফনের সময় রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও চান না। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) চিঠি দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল হোসেন। সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে অনিয়মের প্রতিবাদ এভাবেই করেছেন তিনি।

একাত্তরে রণাঙ্গনের এই বীর সেনানীর বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ফুলছেন্না গ্রামে। তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের (তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহকুমা বাদে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা এবং রংপুর ও গাইবান্ধার কিছু অংশ) অধীনে যুদ্ধ করেন। ক্ষোভের কারণ জানতে চাইলে গত বৃহস্পতিবার আবুল হোসেন বলেন, ‘একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার বিবেকের তাড়না আছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা বীর উপাধি পেয়ে যাচ্ছেন। এর প্রতিবাদস্বরূপ “বীর” উপাধি বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যত দিন বেঁচে থাকব, একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে থাকতে চাই। আর দাফনের সময় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নেব না। কারণ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও তো দাফনের সময় একই মর্যাদা পাবেন।’

মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন গত মঙ্গলবার মেলান্দহের ইউএনও তামীম আল ইয়ামিনের কাছে এই চিঠি দিয়েছেন। দুই পৃষ্ঠার চিঠিতে তিনি সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে কথা বলেছেন। পাশাপাশি ভুয়া ও নামধারী মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে ভবিষ্যতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কী অবস্থা হতে পারে, তা উল্লেখ করছেন।

জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, ‘আমার মনে হয়, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে অনিয়মের অভিযোগে তিনি কষ্ট পেয়েছেন। সেই অভিমান থেকে তিনি এমন চিঠি দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করা হচ্ছে।’

অর্থ লেনদেন

চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই যুগ পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নের বিষয়ে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ান। ভাতা ও সম্মান দুটিই চালু করেন। প্রধানমন্ত্রী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির ওপর তাগিদ দেন। কিন্তু একটি কুচক্রী মহল সময়ে সময়ে এর সুযোগ নিয়েছে। তারা বহু অমুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত করেছে। অনেকে মুক্তিযুদ্ধকালে শিশু ছিল। তারাও তালিকায় নাম উঠিয়েছে। অনেকে যুদ্ধই করেননি, কিন্তু যুদ্ধাহত ভাতা নিচ্ছেন। মূলত মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারও আঁতাত রয়েছে। ফলে অনেকে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তির সাহস পাচ্ছেন।

চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করতে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শুরু করার নির্দেশ দেন। যেসব মুক্তিযোদ্ধা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করলেও তালিকার বাইরে ছিলেন, তাঁদের অন্তর্ভুক্তিই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু মাঠপর্যায়ে তা হয়নি। অর্থের বিনিময়ে নতুন তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঢোকানো হয়েছে।

ভুয়াদের রাজত্ব

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা এখন বয়োবৃদ্ধ। দিনে দিনে তাঁদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ওদিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ছে।

একটি জাতীয় দৈনিকের খবরের বরাত দিয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই হয়েছে ছয়বার। এই যাচাই-বাছাইয়ের নামে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর ঘটনা বেড়েই চলেছে। এখন ভাতা পাচ্ছেন ২ লাখ ৩৪ হাজার। হয়তো আগামী ১০ বছরে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তখন হয়তো জীবিত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যাবে না। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাই তখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রাজত্ব করবেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-নাতি-পুতিদের হটিয়ে ভুয়ারাই কোটা বসাবে।

চিঠিতে বলা হয়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তর সালে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। খেয়ে না-খেয়ে যুদ্ধ চালিয়েছেন। বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। অনেকে বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব। সেই মুক্তিযোদ্ধা আর ভুয়া ও নামধারী মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা কখনো এক হতে পারে না।

সঠিক তালিকা হবে না

চিঠিতে আরও বলা হয়, স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা হয়নি। ভবিষ্যতে হবে—এমন বিশ্বাসও নেই। কারণ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঠেকাতে সারা দেশ থেকে বহু দরখাস্ত গেছে। কিন্তু তা কোনো কাজে আসেনি। এর মূলে রয়েছে ওই মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন। অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাও ‘টাকার কাছে চুক্তিতে আবদ্ধ’ বলে চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে।

মেলান্দহ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার আনোয়ার হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ওই সব অভিযোগ তাঁর ব্যক্তিগত।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই থেকে শুরু করে যাঁরা তালিকা করেন, তাঁদের জন্য এটা একটা সতর্কসংকেত। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন আমাদের আত্মমর্যাদার জায়গা। এই জায়গায় যেন কোনো দুর্নীতির সুযোগ তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাতে বাদ না পড়েন, এটাও দেখতে হবে। আবার দুর্নীতি যাতে জায়গা করে না নিতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।’

তালিকা পাল্টেছে ছয়বার

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৪৬ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড ১০ বার পাল্টেছে। এখনো পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখের বেশি হলেও অনলাইনে ও সরাসরি আরও দেড় লাখ আবেদন জমা পড়েছে। সাংসদের নেতৃত্বে উপজেলা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ে কমিটি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করে সোয়া চার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এখনো তা চূড়ান্ত হয়নি। বরং সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে।

মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য অর্থ লেনদেনের কথা যেমন শোনা যায়, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণিত হওয়ায় ছয় সচিবসহ তিন হাজার ব্যক্তির নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ার ঘটনাটিও দেশজুড়ে বেশ আলোচিত।

অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা না হওয়া সত্ত্বেও লাল মুক্তিবার্তায় অনেকের নাম রয়েছে। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর সই স্ক্যান করে সনদ জাল করেছেন। কেউ কেউ জেনারেল এম এ জি ওসমানীর খোদাই করা স্বাক্ষর জাল করেছেন। জেলা-উপজেলা কমান্ডারের সই জাল করে বা যাচাই-বাছাই না করে সনদ দেওয়ার অভিযোগও অসংখ্য।