মেগা পাঁচ প্রকল্পে আরও বিনিয়োগে আগ্রহী জাপান

অবকাঠামো খাতের মেগা পাঁচ প্রকল্পে আরও বিনিয়োগে আগ্রহী জাপান। এ জন্য জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল সম্প্রতি এসব প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে। এসব প্রকল্পে আরও বিনিয়োগের জন্য জাপানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে জানিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি জাইকা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে একটি চিঠি দিয়ে এসব বিষয়ে অবহিত করেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পগুলো হচ্ছে- মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট, ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহীতকরণ প্রজেক্ট এবং ইমার্জেন্সি ইফিসিয়েনসি অ্যান্ড কনজারভেশন প্রমোশন প্রজেক্ট।

জাপান ইতোমধ্যে মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্টে ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে। চিঠিতে জাইকা জানিয়েছে, তাদের পরিদর্শক দল এসব প্রকল্পের বিষয়ে বেশ ইতিবাচক রিপোর্ট প্রদান করেছে। এসব প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা, আগামীতে এগুলোর ব্যবহার সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সুবিধার সবকিছু তাদের আকৃষ্ট করেছে। পরিদর্শনের সময় প্রতিনিধি দলকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে ধরনের নিরাপত্তা দিয়েছে তাতে তারা খুবই সন্তুষ্ট। তাই তারা বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, ধারাবাহিকভাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ পরিস্থিতি বিশিষ করে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর বিদেশি উদ্যোক্তাদের আস্থার জায়গা এখন বাংলাদেশ। বিশেষ করে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের বড় বড় অবকাঠামো খাতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।

এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনবার জাপান সফর করেছেন। জাপান আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক অংশীদার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে জাপান। স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি বাংলাদেশকে ১৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।

‘বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতের ৪০টি প্রকল্পে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে জাপান। এ জন্য বাংলাদেশ জাপানের প্রতি কৃতজ্ঞ’- যোগ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।

তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের এসে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। অতি সম্প্রতি জাপান সফর প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিনিয়োগ পলিসি, সস্তা ও দক্ষ জনশক্তি এবং বিনিয়োগের পরিবেশ জাপানি উদ্যোক্তাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কিনে নিয়েছে। অবকাঠামো খাতের পাঁচ মেগা প্রকল্পে আরও বেশি বিনিয়োগসহ বিভিন্ন প্রকল্পে তারা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে।’

এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সর্ববৃহৎ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, এর আগেও বিভিন্ন খাতে জাপান বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগে সুযোগ-সুবিধা ভালো। আর্থসামাজিক অবস্থা, জিডিপির প্রবৃদ্ধি- সবকিছু মিলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশে ভাবমূর্তি খুব ভালো। বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুষ্ঠু একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যেটা তাদের আকৃষ্ট করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জাপানের পাশাপাশি থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রেরও বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ আছে। এর ধারাবাহিকতায় তারাও আসছে। তারা যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে তাহলে আমরা তাদের সার্বিক সহযোহিতা দেবো।’

সূত্র জানায়, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ গত জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে। কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হবে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তিতে। প্রকল্প এলাকায় সড়ক নির্মাণ, টাউনশিপ গড়ে তোলাসহ আনুষঙ্গিক কাজের প্রায় ১৮ শতাংশ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।

মাতারবাড়ী ইউনিয়নে ১৪১৪ একর জমির ওপর এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকারের কাছ থেকে ঋণ সহায়তা হিসেবে পাওয়া গেছে ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি তিন লাখ টাকা। সরকারের তরফ থেকে সাত হাজার ৪৫ কোটি ৪২ লাখ টাকার জোগান দেয়া হচ্ছে।

সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করে এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হবে বলে আশা করেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে বাস্তবায়নাধীন যে ১০টি প্রকল্প রয়েছে তার মধ্যে খরচের দিক দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরই রয়েছে মাতারবাড়ীর প্রকল্পটি।

২০১৫ সালের আগস্টে মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ৩৬ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। কিন্তু দরপত্র প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই পরের বছর জুলাইয়ে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় জাপানি প্রকৌশলীসহ ১৭ বিদেশি নিহত হওয়ায় সেই দরপত্র প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে পড়ে।

সব সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে গত বছর ২৭ জুলাই এই প্রকল্প বাস্তবায়নে জাপানি কনসোর্টিয়াম সুমিতোমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশন ও আইএইচআই করপোরেশন-এর সঙ্গে চুক্তি করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড- সিপিজিসিবিএল।

মহেশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও গভীর সমুদ্র বন্দর ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) টার্মিনাল স্থাপন করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও নগর গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে সরকার। এতে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা হচ্ছে।