যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালে ধীরগতি কেন?

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের ৯ বছরে এসে এখন ধীরগতি স্পষ্ট৷ প্রসিকিউটররাও তা স্বীকার করছেন৷ তাঁরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে পরে অনেক মামলাই প্রমাণ করা যাবেনা৷

নয় বছরে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মোট ৩৫টি মামলার রায় দিয়েছে৷ আর এখন বিচার চলছে ৩৪টি মামলার৷ তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে এমন অভিযোগের সংখ্যা ২৮টি৷ প্রায় চার হাজার আসামির বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৭শ’র মতো তদন্তযোগ্য অভিযোগ রয়েছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন তদন্ত সংস্থার সহ-সমন্বয়ক এম সানাউল হক৷ আর এখনো অভিযোগ আসছে৷

২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়৷ শুরুতে একটি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার কাজ শুরু হলেও ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়৷ দু’টি ট্রাইব্যুনাল একযোগে আড়াই বছর কাজ করে৷ এরপর ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুইটি ট্রাইব্যুনালকে একইভূত করা হয়৷ ফলে ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত একটি ট্রাইব্যুনালই বিচার কাজ করছে৷ একটি ট্রাইব্যুনালের পক্ষে বছরে ৪-৫টির বেশি মামলার বিচার কাজ সম্ভব হয়না৷

এখন ট্রাইব্যুনালে বিচার পর্যায় যে ৩৪টি মামলা আছে তারমধ্যে দুটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ। ওই দুটি বাদ দিলে এই একটি ট্রাইব্যুনাল স্বাভাবিক গতিতে বিচার কাজ করলে ৩২টি মামলার বিচার শেষ করতে সময় লাগবে ৭ থেকে ৮ বছর৷

আলোচনায় নেই ট্রাইব্যুনাল

শুরুর কয়েক বছর ট্রাইব্যুনাল যেভাবে আলোচিত ছিল, মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল, সেই আলোচনা আর আগ্রহ এখন ট্রাইব্যুনাল নিয়ে নেই৷ সাধারণ মানুষও এখন আর আগের মতো রায়ের জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে না৷ এখন রায় হলে সংবাদমাধ্যম গুরুত্বহীনভাবে খবর পরিবেশন করে৷

বিশ্লেষকরা বলছেন, এর একটা কারণ হয়ত হতে পারে যে আলোচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হয়ে গেছে৷ অনেকের দণ্ডও কার্যকর হয়ে গেছে৷ ফলে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমে গেছে৷ কিন্তু সরকারের ঘোষণা ছিল, দেশে একজন মানবতাবিরোধী অপরাধী থাকা পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের কাজ চলবে৷

আলোচিত মামলা

ট্রাইব্যুনাল এপর্যন্ত যে ৩৫টি মামলার রায় দিয়েছে তাতে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ৮০ জন৷ তাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে ৫২ জনকে৷ পুরো বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে সাত জনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে৷ যাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে তারা হলেন, জামায়াতে ইসলামীর মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মজলিসে সুরা সদস্য মীর কাসেম আলী এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী৷

আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী৷ ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে৷ আর আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীমকে৷ এই দুই জন রায়ের বিরুদ্ধে পৃথক আপিল করেছিলেন৷ কিন্তু কারাগারেই তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়৷ ফলে তাদের আপিল অকার্যকর হয়ে গেছে৷

২৮ আপিল, শুনানি হয়না ৩ বছর

ট্রাইব্যুনাল যেসব মামলার রায় দিয়েছে তার বিরুদ্ধে ২৮টি আপিল এখনো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিস্পত্তির অপেক্ষায় আছে৷

জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম ও মুহাম্মদ আবদুস সুবহান এবং জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ মো. কায়সারের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে পৃথক আপিল শুনানির জন্য কয়েকবার আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় উঠলেও তার শুনানি এখনো শুরু হয়নি৷ কার্যত গত তিন বছর ধরে আপিল শুনানি আর হচ্ছেনা৷

যেভাবে কাজ করে ট্রাইব্যুনাল

টাইব্যুনালের দু’টি অংশ: তদন্ত সংস্থা এবং প্রসিকিউশন৷ তদন্ত সংস্থা কোনো মামলার তদন্ত পুরো শেষ করে প্রসিকিউশনকে দিলে প্রসিকিউশন মামলা করে ট্রাইব্যুনালে৷ ট্রাইব্যুনাল মামলার বিচার কাজ শেষ করে রায় ঘোষণা করে৷ তবে এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করা যায়৷ ফলে রায় কার্যকর হয় আপিল বিভাগের রায়ের পরই৷ আপিল বিভাগের রায়ের পরও রিভিউ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার আইনি সুযোগ আছে৷

কেন ধীরগতি?

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ মামলার এই ধীরগতির কথা স্বীকার করেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মামলার যে ধীরগতি তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই৷ আর এখন মাত্র একটি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে৷ দু’টি ট্রাইব্যুনাল করা হলেও একটি ট্রাইব্যুনাল এখন আর নেই৷”

তিনি বলেন, ‘‘তারপরও ট্রাইব্যুনাল যে সব মামলার বিচার শেষ করেছে তার বড় একটি অংশ আপিলে আটকে আছে৷ আপিল নিস্পত্তিতো আর ট্রাইব্যুনালের হাতে নেই৷ ট্রাইব্যুনাল শুধু মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করলেও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগতো শুধু এই এক ধরণের মামালার আপিলই শোনেননা৷ তারা আপিলযোগ্য সব মামলারই আপিল শোনেন৷ আর ট্রাইব্যুনাল এই ধরণের মামলা করতে করতে অভিজ্ঞ৷”

ব্যারিস্টার আফরোজ আরো বলেন, ‘‘অন্যদিকে তদন্ত সংস্থার তদন্ত যদি সঠিক না হয় তাহলেও মামলা দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে যায়৷ আবার তদন্ত করাতে হয়৷ কারণ ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা ফাইল করলেইতো হবেনা, তাতো প্রমাণ করতে হবে৷”

তদন্ত সংস্থার সহ-সমন্বয়ক এম সানাউল হকও ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন একটিমাত্র ট্রাইব্যুনাল থাকায় মামলা নিস্পত্তির হার কমে গেছে৷ ফলে বিচারের গতি অনেকটাই কম৷ আর গত তিন বছর ধরে কোনো আপিল শুনানি হচ্ছেনা৷ আপিল শুনানি না হওয়া হলেতো মামলার চূড়ান্ত নিস্পত্তি হয়না৷ রায়ও কার্যকর হয়না৷” তিনি আরো বলেন, ‘‘তদন্ত সংস্থায়ও কাঠামো অনুযায়ী জনবল নেই৷ আমরা জনবলের জন্য আবেদন করেছি৷”

ধীরগতি জটিলতা সৃষ্টি করবে

তুরিন আফরোজ বলছেন, ‘‘আমরা বলেছি দেশে একজন যুদ্ধাপরাধী থাকাপর্যন্ত আমাদের কাজ চলবে৷ কিন্তু সাক্ষ্য প্রমাণ থাকতে হবে তো? অনেক সাক্ষী এরই মধ্যে মারা গেছেন৷ অনেক ডকুমেন্ট এখন আর পাওয়া যায়না৷ ফলে এই ধীরগতি ভবিষ্যত বিচারে জটিলতা সৃষ্টি করবে৷ মামলা প্রমাণ কঠিন হয়ে পড়বে৷”

তদন্ত সংস্থার সহ-সমন্বয়ক এম সানাউল হক বলেন, ‘‘আমরা তদন্তের গতি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি৷ প্রতি মাসেই ২-৩টি তদন্ত শেষ করছি৷ এখন আমরা চেষ্টা করছি অভিযোগের মেরিট বুঝে যে অভিযোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোর তদন্ত আগে শেষ করতে৷ আমরা চেষ্টা করছি সাক্ষীরা জীবিত থাকতেই তাদের জবানবন্দি গ্রহণ করতে এবং তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংগ্রহ করতে৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘ট্রাইব্যুনালের ধীরগতির কারণে এখন অনেক বাদি এবং সাক্ষী আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন৷ তাঁরা মনে করছেন মামলায়তো কিছু হচ্ছেনা৷ তাহলে এসব করে কী হবে? তারপরও এখনো অভিযোগ আসছে৷”