যেখানে স্বাধীনতার পর কোন চেয়ারম্যানই বেঁচে থাকতে পারেনি

পদ্মার চর ঘেঁষে প্রত্যন্ত অঞ্চল মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বাঘড়া ইউনিয়ন। প্রমত্ত পদ্মায় যেমন মাঝে মধ্যে উত্তাল হয়ে উঠে, বাঘড়া ইউনিয়নও পদ্মার মতো হয়ে উঠে উত্তাল। খুনের বদলা হয় খুন, অস্ত্রের ঝনঝনানিতে সন্ত্রস্ত্র হয়ে উঠে শান্ত এই জনপদ। এই ইউনিয়নে স্বাধীনতার পর থেকে নির্বাচিত কোন চেয়ারম্যানই বেঁচে থাকতে পারেনি। এলাকার মানুষ বিচারের বিশ্বাস করে না, তারা মনে মনে, খুনের বদলা খুন- এটাই তাদের বিচার। এখন শুধু বেঁচে আছেন বর্তমান চেয়ারম্যান। তিনিও জানালেন আতঙ্কে দিন কাটে তার।

সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের বাড়িতে প্রকাশ্যে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে আহত করা হয় আকাশ ওরফে আশিক (২১) ও শাকিল (২৩) নামের দুই তরুনকে। এর মধ্যে আকাশ মারা গেছে। পঙ্গু অবস্থায় দিন পার করছে শাকিল। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এরা যুবলীগ নেতা শাহীন হত্যায় জড়িত। তাই নিহত শাহীনের স্বজনরা হত্যার শাস্তি হিসেবে প্রকাশ্যে তারা হত্যা করে। তবে চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ইত্তেফাকের কাছে দাবি করেন, বাড়িতে নয়, আকাশের ঘটনা আমার অফিসে ঘটেছে। সেখানে শাহীনের স্বজনরা তাদের উপর নির্যাতন করেছে। আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। আমি পুলিশকে জানিয়েছি। পুলিশ গিয়ে ওই দুই ছেলেকে উদ্ধার করেছে।

জানা গেছে, ওই দুই তরুনকে নেয়া হয় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে। সেখানেই আকাশ মারা যায়। কিন্তু আকাশের পরিবার কোন মামলা করতে পারেনি। এই ঘটনায় একটা ইউডি মামলা হয়েছে। এমনকি আকাশের লাশের দাফনও এলাকায় নিয়ে করা যায়নি। জুরাইন কবরস্থানে তার লাশ দাফন করে গেছে পরিবার। এরপরও নিহতের পরিবারের মধ্যে রয়েছে আতঙ্ক।

তবে শ্রীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। আমি বিষয়টি দেখব।’ মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, ‘বাঘড়ায় আমাদের একটা পুলিশ ক্যাম্প আছে। সেখানে স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ির চেষ্টা করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘অন্য এলাকার অপরাধের ধরনের চেয়ে এই এলাকার অপরাধের ধরণ আলাদা। এরা সব সময় মারামারির জন্য প্রস্তুত থাকে। আমরা এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি, কেউ অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।’

এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই এলাকায় পুলিশ আসে বড়লোক হতে, কোটি কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত খুন হয়েছে শতাধিক। এর মধ্যে কোন চেয়ারম্যানই বেঁচে নেই। সৌরভ আলী মাস্টার, সাহাবুদ্দিন মাস্টার, মনোয়ার আলী, তার বাবা জমসের মাকতুব্বর, (তিনি ভাইস চেয়ারম্যান) আইয়ুব আলী মারা গেছেন। শুধু বর্তমান চেয়ারম্যান বেঁচে আছেন। এখানে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা হয়, চলে অস্ত্র কেনা-বেচা। নারীরাও এখানে অস্ত্র ব্যবহার করে। এখানে খুনের পাল্টা খুন।

২০০১ সালে হ্যান্ডকাপ পরা অবস্থায় পুলিশের ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চেয়ারম্যান মনোয়ার আলীসহ ৫ জনকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করে। অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে পরস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এই ঘটনায় কয়েকজনের ফাঁসির আদেশ হয়। তার মধ্যে শুধু ততকালীন চেয়ারম্যান আইয়ুব আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। ২০১৪ সালেও শামসু (২৪) নামে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করে। ওই এলাকায় হত্যাকান্ডের ধরনই এমন।

বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, ‘যখন আমার দাঁড়ি গোফ উঠেনি, তখন আমি সৌদি আরব গেছি। ৩৫ বছর পর দেশে আসি ৮/৯ বছর আগে। ২০১১ সালে আওয়ামী সমর্থক হিসেবে নির্বাচন করে জয়লাভ করি। আমার পরিবার ঢাকায় থাকে। ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই ক’বছরে ৩/৪টা হত্যাকান্ড ঘটেছে। পরিস্থিতি আমি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি।’ তিনি স্বীকার করেন, এলাকায় মাদকের সমস্যা আছে, আছে অবৈধ অস্ত্রও। তারপরও তিনি জনগনের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।