রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি : সংস্কারের সুফল তৈরি পোশাক খাতে

দেশের পোশাক শিল্পের ইতিহাসে বড় ট্র্যাজেডির নাম রানা প্লাজা ধস। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় এক হাজারেরও বেশি শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হয়। আহত হন কয়েক হাজার শ্রমিক। ওই ঘটনা শুধু বাংলাদেশকে নয়, পুরো বিশ্বকে নাড়া দেয়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি। সমালোচনার মুখে পড়েন তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা।

এরপরই নড়েচড়ে বসে সরকার, শিল্পমালিক, শ্রমিক ও ক্রেতাগোষ্ঠী। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে শুরু হয় সংস্কার। মালিকদের দাবি গত পাঁচ বছরের ধারাবাহিক সংস্কারে তৈরি পোশাক খাত আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছেছে। যার সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ।

জানা গেছে, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর দেশ-বিদেশে আলোচনায় আসে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মান ও শ্রমিকের কর্মপরিবেশ। ওই বছর থেকে সরকার, উদ্যোক্তা, শ্রমিক ও বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা সমন্বিতভাবে এ খাতের সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।

প্রাথমিকভাবে সাড়ে তিন হাজার কারখানার মানোন্নয়ন ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ শুরু করে অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও এনআই। কারখানাগুলো পরিদর্শন শেষে ওই তিন সংস্থা সাড়ে ৭৪ হাজার সমস্যা চিহ্নিত করে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর আইনি কাঠামো, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। আইনি কাঠামোর মধ্যে ২০১৩ সালে শ্রম আইন সংশোধন হয়। ২০১৫ সালে আইনের রুল জারি হয়। এছাড়া সাব কন্ট্রাক্টিংসহ বেশকিছু আইনের বিষয়ে কাজ চলছে যা ইতিবাচক। পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। অ্যাকর্ডভুক্ত ৮৪ শতাংশ ও অ্যালায়েন্সভুক্ত ৩২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তামান নিশ্চিত হয়েছে। এটি খুবই আশার দিক। তবে সংগঠনের সদস্য নয়, এমন ৬০০-৭০০ কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা বেশ পিছিয়ে। এ বিষয়টি দেখতে হবে।

শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে তিনি বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা বেড়েছে। তবে এখনও ট্রেড ইউনিয়নগুলো পুরোপুরি কার্যক্রম চালাতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে হুমকি-ধামকিসহ বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

সিপিডির এ গবেষণা পরিচালক বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ বেশ অগ্রগতি হয়েছে। ইমেজ সংকট কেটে অনেকটা ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। এর সুফল আমরা পাচ্ছি। আগামীতে আরও পাব। সংস্কার ও উন্নয়নের এ অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনা মালিকদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে অবহেলা করা যাবে না। ওই ঘটনার পর বিভিন্ন পক্ষের সহযোগিতায় কারখানাগুলো সংস্কার করা হয়। গত পাঁচ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণ করেই কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে। সবাই বুঝতে পেরেছেন, শ্রমিকের নিরাপত্তা সবার আগে। এ ক্ষেত্রে বিজিএমইএ বেশ সতর্ক।

পোশাক মালিকদের এ নেতা বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশসহ অনেক সংস্কারের কাজ হয়েছে। এর সুফল ইতোমধ্যে আমরা পাচ্ছি। এ খাতে রফতানি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। গত বছর দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল, এ বছর সেটা ১১ শতাংশ হয়েছে।

যারা এখনও সংস্কার বা কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করেনি তাদের বিষয়ে বিজিএমইএ’র অবস্থান কী- জানতে চাইলে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র সদস্য নয়, এমন প্রতিষ্ঠানে কোনো দুর্ঘটনা হলে এর দায়িত্ব আমরা নেব না।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আট মাসে দুই হাজার ২৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৮৬৩ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। এ হিসাবে তৈরি পোশাক রফতানি বেড়েছে আট দশমিক ৬৮ শতাংশ।

এদিকে পোশাক শ্রমিকদের সংগঠন জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোট বাংলাদেশের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন সহিদ বলেন, গত পাঁচ বছরে কারখানাগুলোর সংস্কার হয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু কতটুকু সংস্কার হয়েছে? বড় বড় কারখানার মালিকরা চাপে পড়ে সংস্কার করেছেন, কিন্তু ছোট কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ এখনও নিরাপদ নয়।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সংস্কার বিষয়ক উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটির এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে অ্যালায়েন্স তার অধিভুক্ত কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। ৬০০টিরও বেশি কারখানায় ৯০ শতাংশ সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এক হাজার কারখানার ১৪ লাখ শ্রমিক ২৪ ঘণ্টা চালু অ্যালায়েন্স হেল্পলাইন ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে। ১৫ লাখ শ্রমিক অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ওয়ার্কার সেফটি কমিটি গঠন হয়েছে প্রায় ২০০টি কারখানায়।