রিফাত হত্যা : ঘটনাস্থলে থাকলে আপনি কী করতেন?

বরগুনায় রিফাত শরীফকে দিনের বেলা জনসম্মুখে কুপিয়ে হত্যা করার ঘটনার ভিডিওর যে বিষয়টি সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বিচলিত করেছে, তা হলো ঘটনাস্থলে উপস্থিত মানুষজনের চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা।

ভিডিওতে দেখা যায় হামলাকারীরা প্রায় মিনিটখানেক ধরে রিফাতের ওপর আক্রমণ চালালেও তার স্ত্রী বাদে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ স্রেফ দর্শকের ভূমিকাতেই ছিল।

প্রশ্ন উঠেছে: তখন আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাঁচাতে কেন এগিয়ে গেল না কেউ?

এজন্যে নৈতিকতার অভাবকে দায়ী করেন বিথি রহমান। “আমাদের মানসিকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এরকম একটা ঘটনা ঘটতে থাকলে আমরা একটা চাঞ্চল্যকর ভিডিও বা দারুণ একটা ছবি নিজেদের সংগ্রহে রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সেটা নিজেদের প্রোফাইল থেকে শেয়ার দিয়ে আলোচনায় আসতে চাই,” বলেন তিনি।

তার মতে সাধারণ মানুষকে এধরনের পরিস্থিতিতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

“এরকম সহিংস অপরাধ যেহেতু বেড়ে গেছে, তাই পুলিশের উচিত সাধারণ মানুষের কাউন্সেলিং করা এবং প্রশিক্ষণ দেয়া যেন তারা এরকম পরিস্থিতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।”

এরকম পরিস্থিতিতে নিজে পড়লে কী করতেন – এ প্রশ্নের উত্তরে মিজ. রহমান বলেন, একা প্রতিরোধের চেষ্টা না করলেও হয়তো লোকজন জড়ো করে হামলাকারীদের থামানোর চেষ্টা করতেন তিনি।

একই উত্তর পাওয়া যায় এলমা খন্দকারের কাছ থেকেও। তিনি মনে করেন, একা প্রতিবাদের সাহস না পেলেও পুলিশকে ফোন করতেন বা ছোটাছুটি করে মানুষ জড়ো করার চেষ্টা করতেন তিনি; তবে নিস্পৃহভাবে দাড়িয়ে থাকতেন না অন্তত।

এই একই প্রশ্নের জবাবে বিবিসি বাংলায় রেডিওর ফোন ইন অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম থেকে রাশেদুজ্জামান রাশেদ বলেন, “যদি কেউ সাহায্য করতো তাহলে তাদেরকেও সন্ত্রাসীরা চিনে রাখতো এবং পরে তারা হয়তো তাদের বাড়িতে হামলা করতো, রাস্তায় তার লাশ পড়ে থাকতো!”

এরকম পরিস্থিতিতে আপনি কী করতেন এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমার প্রতিবাদ করার অনেক আগ্রহ। কিন্তু আমি যখন প্রতিবাদ করতে যাবো, তখন সামনে আরেকজন এসে দাঁড়িয়ে বলবে ‘নায়কগিরি করছো তো, এখন দেখ তোমার অবস্থা’, তখন আমারই পা ভেঙে দেবে।”

তবে এ ধরনের ঘটনায় সাধারণ মানুষের না এগিয়ে আসার বিষয়টিতে একেবারেই অবাক হন নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক সামিনা লুৎফা। তিনি মনে করেন, এমন ক্ষেত্রে মানুষের এগিয়ে না আসাটাই বরং স্বাভাবিক।

“সাধারণ মানুষের ওপর দোষ চাপানো উচিত না। দিনের বেলা সবার সামনে যারা এরকম সহিংস আক্রমণ করতে পারে, তারা যে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থেকেই এ ধরনের হামলা চালায়, তা তো স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়,” বলেন তিনি।

সমাজবিজ্ঞানী সামিনা লুৎফা বলেন, “বরগুনার মত ছোট জায়গায় সবাই সবাইকে চেনে। তাই এরকম হামলা যারা করছে, তারা যে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এমন অপরাধ করছে তা স্বাভাবিকভাবেই জানে মানুষ। তাদের বাধা দেয়ার পর তারা বাধা দানকারী বা তার পরিবারের বিরুদ্ধে কীরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা অনুমান করেই হয়তো মানুষ বাধা দিতে যায়নি।”

বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সামাজিক মাধ্যমে কোনো ঘটনা ছড়িয়ে না পড়া পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা এবং অপরাধ করে ক্ষমতাসীনদের পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই সাধারণ মানুষ ঝুঁকি নিয়ে এসবের প্রতিবাদ করে না বলে মনে করেন মিজ লুৎফা।

রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতির কারণে মানুষ এধরনের পরিস্থিতিতে এগিয়ে যায় না বলে মনে করেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদাও।

তিনি বলেন, “একথা ঠিক যে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরে মানুষের আত্মবিশ্বাস বর্তমানে কিছুটা কম। তবে আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধির শুরুর দিকেই এ ধরনের অপরাধ মোকাবেলায় জনগণের সামাজিক দায়িত্বের বিষয়ে বলা আছে।”

পুলিশের সাবেক এই প্রধান মনে করেন, মানুষের মধ্যে এই নিস্পৃহ মনোভাব পরিবর্তনের দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সামাজিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপরও বর্তায়।

তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে বিচার ব্যবস্থা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্বও প্রশাসনের।

বিভিন্ন সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত একমাসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় জনসম্মুখে এরকম কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছ বিশটিরও বেশি।