রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনড় কফি আনান, নড়েনি চীন-রাশিয়াও

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আগের অবস্থানেই রয়েছে পরাশক্তি চীন ও রাশিয়া। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক অনির্ধারিত বৈঠকে নিপীড়ক রাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে দেশ দুটি সাড়া দেয়নি।ফলে বলা চলে, দ্বিতীয়বারের মতো রোহিঙ্গা মুসলিম ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ব্যর্থ হলো। প্রথমবারও এই দেশ দুটি মিয়ামারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিল।

গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে সহিংসতা শুরু হয়। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানে আন্তর্জাতিক মহলের দাবি মতে, ৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম নিহত হয়েছেন। আর নির্যাতনের মুখে সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।

যদিও মিয়ানমার সরকারের দাবি, তাদের ‘শুদ্ধি’ অভিযানে নিহত হয়েছে ৫০০ সন্ত্রাসী।

জাতিসংঘ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানটিকে ‘জাতিগত নিধন’ ও গণহত্যা বলে উল্লেখ করেছে। সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্তনি গুতেরেস রাখাইনে সেনা অভিযান বন্ধ, ঘরবাড়ি জ্বালানো থামানো এবং দুর্গতদের জন্য সব ধরনের ত্রাণ সহায়তার সুযোগ দেওয়ার সঙ্গে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে মূলত শুক্রবার জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সাং সু চির গঠিত কমিশনের প্রধান কফি আনানের বক্তব্য শুনতে বৈঠকে বসে নিরাপত্তা পরিষদ।

কূটনীতিক সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে কফি আনান রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে তার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন তুলে ধরেন।

নিরাপত্তা পরিষদকে তিনি পালিয়ে যাওয়া ৫ লাখ রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে নয়, তাদের নিজ ভূমিতে ফেরত আনার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

কফি আনান বলেন, ‘সম্মান ও নিরাপত্তার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে যাতে রোহিঙ্গা রাখাইনে ফেরত আসতে পারেন, মিয়ানমার সরকারের সেই পরিবেশ তৈরি করা উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গারা অবশ্যই কোনো ক্যাম্পে ফেরত আসবেন না। নিজ বাসভবনে ফেরার বিষয়ে তাদের সহযোগিতা করতে হবে।’

কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই এই বৈঠক শেষ হলেও একটি অগগ্রতির খবর জানানো হয়, জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিষয়ক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জেফ্রি ফেল্টম্যান সঙ্কট নিয়ে আলোচনার জন্য শুক্রবার থেকে চার দিনের মিয়ানমার সফর শুরু করেছেন।

জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, জেফ্রি ফেল্টম্যান মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করবেন।

গত বছরের অক্টোবরে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের একই ধরনের হামলার শিকার হন রোহিঙ্গা

মুসলিমরা। সে সময় চার শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিলেন। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া এবং নারীদের ধর্ষণের মতো ঘটনার প্রমাণ পেয়েছিল জাতিসংঘ।

ওই ঘটনার তদন্তে গঠিত কফি আনানের কমিশন গত ২৩ আগস্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া এবং তাদের প্রতি বৈষম্য কমিয়ে আনাসহ একাধিক সুপারিশ করা হয়।

সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন দূরে থাক, পরদিন থেকেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে অভিযানের নামে রোহিঙ্গা নিধন শুরু করে।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার দুরবস্থার বিষয়ে আলোচনার জন্য ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের আহ্বানে শুক্রবার বৈঠকে বসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ।

কূটনৈতিক সূত্রের খবর, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরতের পদক্ষেপ বিষয়ে ব্রিটেন নিরাপত্তা পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে। কিন্তু, মিয়ানমারের সাবেক জান্তা সরকারের সমর্থন দেওয়া চীন এ বিষয়ে আলোচনার জন্য খুবই ‘ধীর’ পদক্ষেপ নিচ্ছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সদস্য সব দেশ ছাড়াও সঙ্কটপূর্ণ অঞ্চলের কিছু দেশ এবং সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

গত মাসেও ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্র একই ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেছিল। সেটিও ভেটো ক্ষমতাধর চীন ও রাশিয়ার অবস্থানে ভেস্তে যায়।

ওই বৈঠক শেষে ‘জাতিগত নিধনের’ শিকার রোহিঙ্গাদের বিষয়ে চীনের রাষ্ট্রদূত ‘ধৈর্য’ ধরার আহ্বান জানান। আর রাশিয়ার পক্ষ থেকে সতর্ক করে বলা হয়, কোনো দেশের ওপর এ ধরনের ‘বাড়তি চাপ’ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।

তবে এদিনের ব্যর্থ বৈঠকেও ‘ব্যবহার’ ও ‘সহায়তাযোগ্য’ দুটি লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বলে জানানো হয়। ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ফ্রানকোয়েস ডেলাত্রে বলেন, আনান কমিশনের প্রতিবেদনকে সমর্থন এবং ইস্যুটি নিয়ে যে স্থিতিবস্থা তৈরি হয়েছে, তা অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

ডেলাত্রে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের একটি সেশনে জাতিসংঘে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ম্যাথু রেক্রফটের কো-চেয়ার ছিলেন।

মিয়ানমারের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ অথবা কোনো রেজ্যুলেশনের বিষয়ে ম্যাথু রেক্রফট বলেন, ‘প্রত্যেকেই আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিষয়টি নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং যার যতটুকু করা সম্ভব তা করবেন।’

তবে জাতিসংঘে নিযুক্ত চীন এবং রাশিয়ার দূতকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।