শাহজালাল বিমানবন্দরে অপরাধের শাস্তি ‘বই পড়া’!

রাজধানীর একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে শাস্তি দিতে এক অভিনব উপায় চালু হতে যাচ্ছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ছোট অপরাধের শাস্তি হিসেবে বই পড়া কার্যক্রম শুরু করেছে ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়।

গত ৮ মার্চ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে শাস্তির এই অভিনব পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বিমান বন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুফ এ উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি বলেন, অন্ধকার দূর করতে আলোর বিকল্প নাই। তাই এ ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। কেউ টুকিটাকি অপরাধে ধরা পড়লে তাকে বই পড়তে বাধ্য করা হবে। আর যারা পড়তে পারে না তাদের পড়তে শিখতে হবে।

শাস্তির কবলে পড়া অপরাধীকে এক সপ্তাহ পর বই জমা দিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। তবে পড়া শেষ করে সেই বই ফেরত দেয়া যাবে না। অভিযুক্ত ব্যক্তিই বইটির মালিক হবে এবং যত্ন করে সেই বই বাসায় রেখে দেবে। ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাসায় বই দেখে হয়তো ভবিষ্যতে কখনও পড়তে আগ্রহী হবে। কিন্তু অফেরতযোগ্য হওয়ায় লাইব্রেরিতে বইয়ের ঘাটতি হবে। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি একটি নতুন বই কিনে লাইব্রেরিতে জমা দেবে- বলেন ইউসুফ।

এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন এই ম্যাজিস্ট্রেট। পাঠকদের জন্য তার সেই স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো- `নতুন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। সবার মতামতের ভিত্তিতে সংযোজন-বিয়োজনের প্রত্যাশায় শেয়ার করছি। এয়ারপোর্টে তিন/চার শিফটে ব্যাপক সংখ্যক জনবল কাজ করে। বড়বড় হয়রানি/ক্রাইমের পাশাপাশি কিছু টুকিটাকি লেভেলের হয়রানিও প্রতিনিয়ত হয়। যেমন ট্রলির বিনিময়ে ৫০/১০০ টাকা গ্রহণ, এ জাতীয় মেলা টুকিটাকি। প্রথম প্রথম এই টুকিটাকিদের আর্থিক জরিমানা করতাম। কিন্তু এতে তাদের চাকরি চলে যেত। ফলে দুই ধরনের সমস্যা ফেস করতে হয়, ১) লঘু পাপে গুরুদণ্ড হয়ে যায় এবং ২) নতুন যারা নিয়োগ পায়, তারা আবার নতুন উদ্যোমে শিক্ষানবিশের ভূমিকায় হয়রানি শুরু করে।

বরং পুরাতনদের রেখে কারেকশন করে নেয়াটা উত্তম মনে হতো। তাই ভবিষ্যতে আর করবে না মর্মে লিখিত রেখে ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু সেটাও আবার একেবারে শাস্তিহীন হয়ে পড়ায় খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। যারা এখনও ধরা পড়ে নাই, তারা নিশ্চিন্তে চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে প্রথম হলুদ কার্ড না খাওয়া পর্যন্ত ঠেলে খেলে গোল দেয়ার রিস্ক সব প্লেয়ারই নিয়ে থাকে। সুতরাং উপায়? কারেকশনের জন্য জ্ঞানের চেয়ে শক্তিশালী কিছু হতে পারে না। অন্ধকার দূর করতে আলোর বিকল্প নাই।

টুকিটাকিতে ধরা পড়লেই হাতে একটা বই ধরিয়ে দেয়া হবে। এক সপ্তাহ পর বই জমা দিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এটা তাদের দৃষ্টিতে শাস্তি হতে পারে, আমার দৃষ্টিতে পুরস্কার। অনেকে হয়তো ভাবছেন, আমি কায়দা করে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের বই ধরিয়ে দেব। নাহ, এখানে সব ধরনের বই থাকবে। তবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস তো থাকবেই এবং তা প্রথম সেল্ফের প্রথম সারিতে। অভিযুক্ত স্বাধীনভাবে বুকসেল্ফ ঘাটাঘাটি করে বই নির্বাচন করবে। এতে বাড়তি পাওনা হিসেবে শুরুতেই তার অনেকগুলো বইয়ের নামের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যাবে।

প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা খুব একটা কঠিন বইতে যেতে চাচ্ছি না। মজার মজার সহজ উপন্যাসগুলোতে জোর দেব। উদ্দেশ্য, বই পড়ার মজাটা ঢুকিয়ে দেয়া, জাস্ট সেই নেশার বীজটা বপন করে দেয়া। দ্বিতীয়বার ধরা পড়ার পর থেকে সিলেবাস একটু একটু করে কঠিন হবে, বিষয় এবং সারমর্ম প্রাধান্য পেতে থাকবে। একেবারে স্লো পয়জনিং যেটাকে বলে। পড়া শেষ করে সেই বই ফেরত দেয়া যাবে না।

অভিযুক্তই বইটির মালিক হয়ে যাবে এবং যত্ন করে বাসায় রেখে দেবে। ছেলেমেয়েসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাসায় বই দেখে হয়তো ভবিষ্যতে কখনও পড়তে আগ্রহী হবে। কিন্তু আমার লাইব্রেরিতে অফেরত বইয়ের ঘাটতি কে পূরণ করবে? ভাবছেন, আমি পূরণ করব? ভুল। অভিযুক্তই নতুন একই বই কিনে লাইব্রেরিতে জমা দেবে। লাইব্রেরি থাকবে সবসময় নতুন, ঝকঝকে। আহ, নতুন বইয়ের ঘ্রাণই আলাদা। সেকেন্ড হ্যান্ড বই এই লাইব্রেরিতে নিষিদ্ধ। পড়া শেষে পরীক্ষা পদ্ধতি কি হবে?

এক সপ্তাহ পর, উপন্যাসের গল্পটি ছোট করে নিজের মতো করে রচনা আকারে লিখে আনতে হবে এবং গল্পটি সে জানে কি না, তা তাকে মৌখিকভাবে অল্প সময়ের মধ্যে পরীক্ষা করা হবে। আপনি বলবেন, সে তো অন্য কাউকে দিয়াও লিখিয়ে এনে ফাঁকিবাজি করতে পারে। আবার মৌখিক পরীক্ষার জন্য ওই তৃতীয় ব্যক্তির কাছ থেকে উপন্যাসের গল্প শুনে শুনে একটা আইডিয়া নিয়ে প্রস্তুতি নিতে পারে। আজকাল প্রশ্নফাঁস হলে কেন্দ্রের বাইরে পোলাপান যেমনটা করে আর কি!

কিন্তু কোন সমস্যা নাই। এই ফাঁকিবাজির কারণে তৃতীয় আরেকজন পাঠক বাড়বে। অন্য দিকে সেই ব্যক্তির মুখে শুনে শুনে প্রস্তুতি নিতে গেলেও কাহিনীর ভেতর দিয়া তাকে যেতে হবে। আমি তো কেবল তাকে সাহিত্যের মজাটা ধরিয়ে দিতে চাই, তাই না? উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবে আমার সহকারীরা। আর এজন্য তাদের আগেই রেজিস্টার মেইনটেইন করে পালাক্রমে লাইব্রেরির আংশিক সিলেবাস কমপ্লিট করিয়ে নেয়া হবে। আস্তে আস্তে সব বই তাদের পড়া হয়ে যাবে। বইয়ের পাশে থেকে বই পড়বে না, তা হবে না।

মৌখিক পরীক্ষা নেব আমি এবং আমার কলিগ। আর বুঝতেই পারছেন, না পড়ে কিন্তু আমাদের পরীক্ষক হওয়া যাবে না। কাজেই পাঠক চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়বে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কেউ পরীক্ষায় ডাব্বা মারলে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে? ওয়ান-প্লাস রেফার্ড সিস্টেম ব্যবস্থা থাকবে। কোন কথাবার্তা ছাড়াই আগের বইয়ের সাথে নতুন আরেকটা বই ধরিয়ে দিয়ে আবার এক সপ্তাহ সময় দেয়া হবে। এভাবে তার মাথায় বইয়ের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।

একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ থেকেই যাচ্ছে। পরিচ্ছন্নতা কর্মীসহ অনেকের মধ্যে যদি কেউ একেবারেই পড়াশোনা না জানে, কিংবা কেবল স্বাক্ষর সর্বস্ব হয়, তারা পড়বে কিভাবে? উত্তর একেবারেই সহজ। তারা পড়বে না, পড়তে পারা শিখবে। তাদের জন্য ‘বাল্যশিক্ষা’ পর্যায়ের বই-পুস্তক থাকবে।