শুরু হলো রক্তে রাঙানো ঐতিহাসিক ভাষার মাস

অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা আর রক্তে রঞ্জিত হওয়ার করুণ আখ্যান যেন এ মাস। এ মাসেই ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিবাদ প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষকাল। এই অনবদ্য যাত্রাপথ নিষ্কণ্টক ছিল না।

মায়ের ভাষাকে আপন শৌর্যে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে বীর বাঙালি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিতও ছিল না।  ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ কোনোটাই চেতনাসমৃদ্ধ বাঙালির জন্য কাঙ্ক্ষিত ছিল না। সেটা প্রমাণিত হতেও খুব বেশি সময় লাগেনি।

বাংলা ও বাঙালির জীবনে অপ্রাসঙ্গিক দেশ ভাগ এক কঠোর শৃঙ্খলের রূপ নিয়ে যে উন্মাদনার পরিবেশ তৈরি করে সেখানে বাঙালি দুর্বিনীত, দুর্দমনীয় প্রতিরোধে সম্মুখ সমরকে আলিঙ্গন করতে পিছপা হয়নি। ১৯৪৮ সালে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ছাত্রসমাজ। উদ্দীপ্ত কণ্ঠে দাবি তোলে—না, বাংলাও হবে পাকিস্তানের আর একটি রাষ্ট্রভাষা। এর আগে নতুন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সোচ্চার হন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মওলানা ভাসানি, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবদুল হক এবং সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীসহ আরো অনেক পণ্ডিত ও বিজ্ঞজন।

ড. শহীদুল্লাহ দাবি তুললেন—বাঙালির সংখ্যা বেশি হওয়ায় সরকারি ভাষা অবশ্যই বাংলা ভাষা হবে। তবে উর্দুকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে রাখাও যৌক্তিক। সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক দেশের দৃষ্টান্ত হাজির করে বললেন, এমন কয়েক দেশ আছে যেখানে একাধিক রাষ্ট্রভাষা চলমান। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে এমন অনেক ওজর-আপত্তির মধ্যেই জিন্নাহ তার অভিব্যক্তি ঘোষণা করলেন সরকারিভাবে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন—ভাষার প্রশ্নে আপসহীন লড়াই আর জাতির মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান এক ও অবিচ্ছেদ্য সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুর নিজের জবানিতে রাজনৈতিক জীবনের সংগ্রামী ইতিবৃত্ত যে মাত্রায় লিপিবদ্ধ আছে, সেখান থেকেই অনুমেয় ভাষার প্রশ্নে তার দৃঢ়তা। সেটা নির্ভীক ও দুঃসাহসিক প্রতিবাদে জ্বলে উঠতেও সময় লাগেনি।

বঙ্গবন্ধুর তখন ছাত্রজীবন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগেরও এক সক্রিয় কর্মী। সে সময়ের উদ্দীপ্ত ছাত্রনেতারা ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন বাস্তব প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছেন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলাদেশে সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা ছড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু নিজেই ফরিদপুর জেলায় দায়িত্ব পালনের জন্য চলে যান।

১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে ভোর থেকে শত শত ছাত্রকর্মী রাজধানীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পিকেটিং শুরু করে। তাদের ওপর পুলিশি আক্রমণ হতেও খুব বেশি দেরি হয়নি। পুলিশের লাঠিচার্জও সমান তালে চলতে থাকে। ছাত্রদের মিছিলে নিয়ন্ত্রণ আনতে ব্যর্থ হলে বঙ্গবন্ধুসহ ৭৫ জনকে আটক করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

মাতৃভাষার দাবিতে বঙ্গবন্ধু প্রথম আটক হলেন আরও অনেকের সঙ্গে। স্বাধীনতাসংগ্রামের বীজ বপনে ভাষা আন্দোলনের আবেদন যুগান্তকারী। আর জাতির পিতা সূচনালগ্ন থেকেই মাতৃভাষার লড়াইয়ে নিজেকে উজাড় করে দেন। তবে ঐ দিনের মধ্যে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সেই শুরু ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক যাত্রাপথ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে যা চূড়ান্ত রূপ পায়। যা ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি তৈরিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখে। বলা যায় মুক্তিযুদ্ধ ভাষা আন্দোলনেরই পরিণতি। তাই ফেব্রুয়ারি মাস প্রতি বছরই অনন্য আবেদনে বাঙালিকে তার অস্তিত্বসংকটের ঐতিহাসিক যাত্রাপথকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়।